বিয়ের মরসুম চলছে। লালবাগ আর কান্দির মাঝামাঝি এলাকায় থমকে গেল গাড়ির সারি। রাস্তা দিয়ে বাজনা বাজিয়ে বর যাচ্ছেন বিয়ে করতে। সবার আগে ঘোড়ানাচ, পুতুলনাচ। পিছনে বরযাত্রীর দল। সবশেষে সুসজ্জিত একটা পালকি। সেখানে বসে বর। জনা চারেক বাহক সমস্বরে ‘হেঁইয়ো হো... হেঁইয়ো হো’ বলতে বলতে পালকি বইছেন। পাশেই যাচ্ছে নিতবর। তার বাহন সাদা ঘোড়া। ঘোড়ার গলায় ঘণ্টি। পায়ে ঘুঙুর। কপালে মেহেন্দি।
লোকজন হাঁ করে দেখছেন সেই দৃশ্য। যেন ইতিহাস হয়ে যাওয়া বিয়ের ছবি ফের জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চর্যাপদে বাঙালি বিয়ের বর্ণনার সঙ্গে যেন হবহু মিলে যাচ্ছে ছবিটা। চর্যার এক পদকর্তা কাহ্নপাদ বিয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা, মণ পবণ বেণি করণ্ড কশলা। জঅ জঅ দুন্দুহি সাদ উছলি আঁ। কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলি আ।” অর্থাৎ, মাদল, জোড়া ঢোল-কাঁসি, দুন্দুভি ইত্যাদির জয় জয় শব্দে চারদিক মাতিয়ে কাহ্ন ডোমনীকে বিয়ে করতে চলল।
সেই দ্বাদশ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত বিয়ের বাজারে বাহন হিসেবে পালকির কোনও জুড়ি ছিল না। তারপর মোটর গাড়ির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে পালকি পাড়ি দিচ্ছিল ইতিহাসে। ফের সেই পালকি শহরের পথে কেন? ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্তাদের ছোট্ট জবাব, ‘‘মানুষ চাইছে তাই!’’ তাঁরা জানাচ্ছেন, মানুষের রুচি, চাহিদা সবই সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। সকলেই চাইছেন ‘এক্সক্লুসিভ’ কিছু করতে। পুরনোকে ফিরিয়ে আনতেও তাই পিছপা হচ্ছেন না অনেকেই। আর সেই কারণেই বিয়েতে ফের চাহিদা বাড়ছে পালকি, ঘোড়া ও ফিটনের।
সেন রাজাদের রাজধানী নবদ্বীপে একসময় বহু রাজা, জমিদারেরা বাস করতেন। উৎসব-অনুষ্ঠান-জাঁকজমকে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নতুন নতুন ছক কষতেন তাঁরা। ফলে ফিটন, পালকি, ঘোড়া, হাতি নিয়ে শোভাযাত্রা করে বর-বউ নিয়ে আসার প্রথা এখানে বহু কালের। প্রথম দিকে শোভাযাত্রায় মশাল ব্যবহার হতো। পরে এল গ্যাসবাতি।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নবদ্বীপে এস কে নন্দী ছিলেন সেই অর্থে প্রথম ইভেন্ট ম্যানেজার। টাকা দিলে তাঁর কাছেই মিলত ফিটন থেকে ঘোড়া, গ্যাসের বাতি থেকে ঝাড়লণ্ঠন সবই। এমনকী, সে সবের বাহকের ব্যবস্থাও করে দিতেন তিনিই। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলছেন, “সে সময় নিত্যনতুন জিনিস এনে নন্দীবাবু উৎসবের রং বদলে দিতেন। যত দূর মনে পড়ছে, ১৯৫৫-৫৬ সাল নাগাদ তিনিই প্রথম এ তল্লাটে জেনারেটর নিয়ে আসেন। গ্যাসবাতি বদলে বৈদ্যুতিক আলোয় সেজে উঠল বিয়েবাড়ি, শোভাযাত্রা।”
এখন এক সন্ধ্যায় পালকির ভাড়া হাজার ছয়েক টাকা। শহরের বাইরে গেলে ভাড়া বেড়ে যাবে। কখনও আবার ঘণ্টা পিছুও ভাড়া ধরা হয়। নবদ্বীপের মৃত্যুঞ্জয় প্রামাণিক বলছেন, ‘‘পালকি কিন্তু সকলে বইতে পারেন না। যাঁরা পারেন, তাঁদের আবার সবসময় পাওয়া যায় না। পেলেও তাঁদের মজুরি দিতে হয় মাথাপিছু পাঁচশো টাকা। সঙ্গে নতুন ধুতি, গেঞ্জি আর গামছা। রাতে থাকতে হলে মজুরি দ্বিগুণ।’’
মুর্শিদাবাদে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা এখনও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ঘোড়া মেলেও সহজে। কিন্তু নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরের মতো এলাকায় ঘোড়া নিতে হলে ভরসা সেই বর্ধমান। বিয়েতে সকলের পছন্দ সাদা ঘোড়া। এক রাতের জন্য একটা সাদা ঘোড়ার ভাড়া কমপক্ষে তিন হাজার টাকা। সহিসের জন্য আরও পাঁচশো। সে হোক। লাগুক বেশি টাকা। কিন্তু বিয়ে হতে হবে এক্কেবারে আলাদা। যেন আশপাশের এলাকার লোকও বলাবলি করেন, ‘‘হ্যাঁ, বিয়ে একটা হল বটে!’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy