Advertisement
১৮ মে ২০২৪
ধুন্ধুমার বহরমপুরে

বন্‌ধ সফল করতে রাস্তায় নেমে মার খেলেন সিপিএমের সাংসদ-বিধায়ক

বুধবার সাধারণ ধর্মঘট ঘিরে বহরমপুর-সহ মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় ধুন্ধুমার কাণ্ডে জখম হয়েছেন সিপিএম ও তৃণমূল, উভয়পক্ষের প্রায় ৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওই ১৫ জনই সিপিএমের নেতা ও কর্মী বলে জানা গিয়েছে। জখমদের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হরিহরপাড়ার সিপিএম বিধায়ক ইনসার আলিও।

বন্‌ধের সমর্থনে করিমপুরে মিছিল।

বন্‌ধের সমর্থনে করিমপুরে মিছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বহরমপুর ও রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:১৯
Share: Save:

বুধবার সাধারণ ধর্মঘট ঘিরে বহরমপুর-সহ মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় ধুন্ধুমার কাণ্ডে জখম হয়েছেন সিপিএম ও তৃণমূল, উভয়পক্ষের প্রায় ৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওই ১৫ জনই সিপিএমের নেতা ও কর্মী বলে জানা গিয়েছে। জখমদের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হরিহরপাড়ার সিপিএম বিধায়ক ইনসার আলিও।
নেতৃত্বে এ দিন সকালে এলাকায় মিছিল বের হয়। সেই মিছিল হরিহরপাড়া মোড়ে তৃণমূলের মিছিলের মুখোমুখি হলে উত্তেজনা তৈরি হয়। উপস্থিত পুলিশকর্মীরা দু’পক্ষকে আলাদা করে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করেন। তাতে কাজ না হলে পুলিশ সিপিএমের মিছিলকে রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করে। সেই মিছিল রূপকথা সিনেমা হাউসের কাছে ফের মুখোমুখি হলে দু’পক্ষের কথা কাটাকাটি শুরু হয়।
হরিহরপাড়া জোনাল কমিটির সদস্য রণেন দে-এর দাবি, সে সময়ে তৃণমূলের মিছিল ইটবৃষ্টি শুরু হয়। জখম হন মিছিলের সামনের সারিতে থাকা বিধায়ক ইনসার আলি বিশ্বাস ও হরিহরপাড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক জহুর আলি। বিধায়ক মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে লাঠি দিয়েও মারা হয় বলে সিপিএম নেতৃত্বের দাবি। চোখের নীচে, মুখে, নাকে আঘাত রয়েছে ইনসারের। তিনি মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিধায়ককে বাঁচানোর চেষ্টা করে ইটের টুকরোয় জখম হন হরিহরপাড়ার ও.সি বিভাস মণ্ডল। তাঁর বাঁ-হাতে আঘাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপস্থিত পুলিশ কর্মীরা। বেলডাঙা ১ ব্লকের চক্র সম্পদ কেন্দ্রে বন্‌ধ সমর্থকেরা চেয়ার-টেবিল উল্টে দেয় বলে অভিযোগ। ব্লক অফিসে হাজিরার হার ছিল কম।
বহরমপুরে পুলিশের মারে জখম হয়েছেন সিপিএমের বহরমপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক গণেশ সরকার। তাঁকেও মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এ দিন আক্রান্ত হয়েছেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসানও। তবে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়নি। অভিযোগ, এ দিন বহরমপুরে পুলিশের সামনেই সিপিএমের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ও মোটরবাইকে আগুন ধরিয়ে দেয় তৃণমূল।

সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসানের অভিযোগ, সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ দলের জেলা কার্যালয় থেকে মিছিল বের হতেই ৭৫ মিটার দূরে পুলিশ সেই মিছিল আটকে দেয়। কিছুটা দূরেই ছিল তৃণমূলের লোকজন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পুলিশ হঠাৎ তাঁদের মিছিলে বিনা প্ররোচনায় লাঠিচার্জ শুরু করে। তারপরে তৃণমূলের লোকজনও তাঁদের উপরে হামলা চালায়। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দফায় দফায় দলের জেলা কার্যালয়ে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ মান্নান হোসেন ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘অকারণে সিপিএমের লোকজন আমার গাড়ি ভাঙচুর করেছে ও আমাদের দলের কর্মীদের মারধর করেছে। প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের কার্যালয়েও হামলা চালায়। ১০-১২টা মোটরবাইক ভাঙচুর করে। তখন আমরা তার প্রতিরোধ করেছি মাত্র।’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘এ দিনের ঘটনা ফের প্রমাণ করল গণতান্ত্রিক রুচি, সংস্কৃতি ও অধিকার কিছুই মানে না তৃণমূল।’’ অধীরের হুঁশিয়ারি, ‘‘অদূর ভবিষ্যতে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে তৃণমূলের জন্য। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’’

বন্‌ধের সকালে আরও একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেল। বহরমপুরে পিকেটারদের দেখা না মিললেও সাতসকালে টেক্সটাইল কলেজ মোড়ে ও লাগোয়া বিদ্যুৎ ভবনের পিছনে শ’ তিনেক লোকজনের দেখা মিলল। তাঁদের অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫। তাঁদের হাতে দলের পতাকার বদলে ছিল বাঁশের লাঠি।

ওই জমায়েতের অদূরে বিদ্যুৎ ভবনের জমিতে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মী সংগঠনের দু’টি পৃথক কার্যালয়। দু’টিই তৃণমূলের। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মী সংগঠনের কার্যালয়ে এসে বসলেন তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন। সেখান থেকে সিপিএমের জেলা কার্যালয় ‘সত্যচন্দ্র ভবন’- এর দূরত্ব প্রায় একশো মিটার। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ‘সত্যচন্দ্র ভবন’ থেকে প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসানের নেতৃত্বে সবে সিপিএমের মিছিল বের হয়েছে। তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মী সংগঠনের কার্যালয় থেকে মিছিলের দূরত্ব তখন বড়জোর ২৫ মিটার। সামনেই টেক্সটাইল মোড়। পুলিশের ব্যারিকেড মিছিলের পথ আটকায়। মিনিট তিনেকের মধ্যে শুরু হয় ইটবৃষ্টি। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা প্রাক্তন সাংসদ মান্নান হোসেনের গাড়ির পিছনের কাচ ভাঙচুর হয়। মিছিলের উপর পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠি পড়ে মইনুল হাসানের পিঠেও। ভাঙচুর হয় বেশ কিছু মোটরবাইক ও সাইকেল।

প্রত্যদর্শীরা জানান, পুলিশ ও খেটো লাঠিধারীদের যৌথ আক্রমণে মিছিল পিছু হটে পৌঁছে যায় সিপিএমের জেলা কার্যালয় চত্বরে। মান্নান হোসেনের ছেলে তথা জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব হোসেন তখন খেটো লাঠিধারী বাহিনীর অগ্রভাগে। দুর্বল পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে লাঠি বাহিনী দফায় দফায় পৌঁছে যায় সিপিএমের উত্তেজিত জমায়েতের সামনে। বহরমপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র পশ্চিমে টেক্সটাইল মোড় থেকে পূর্বে সমবায়িকা মোড় পর্যন্ত প্রায় আধ কিলোমিটার এলাকা তখন রণক্ষেত্র। পুলিশের লাঠির আঘাতে নাক ফেটে গল গল করে রক্ত ঝরছে সিপিএমের বহরমপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক গণেশ সরকারের মুখ থেকে।

কয়েক দফা এ রকম চলার পরে সাময়িক বিরতি। তারপরই ফের পুলিশের সামনে দিয়েই খেটোলাঠি বাহিনী রে রে ছুটে যায় সিপিএমের তিন তলা জেলা কার্যালয়ের পূর্ব দিকের পাঁচিল লাগোয়া এফ ইউ সি মাঠে। সেখানে থাকা মোটরবাইকে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেখান থেকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে সত্যচন্দ্র ভবনের একতলা ও দোতলার কাঁচ ভাঙচুর করা হয়। তার একটু পরেই ওই বাহিনী পৌঁছে যায় সিপিএমের জেলা কার্যালয়ে ঢোকার পথের পাশে বহরমপুর ক্লাব (পূর্বতন)- এর সামনে। সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তখন সেখানে সিপিএমের পতাকা, ফেস্টুন জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তার রেশ কাটতে না কাটতেই জলঙ্গিতে ৪টি এবং ভগবানগোলায় ২টি মিলিয়ে সি পি এম এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের মোট ৭টি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।’’

এ দিন বন্‌ধের তোয়াক্কা না করে লরি চালাতে গিয়ে ধুলিয়ান ডাকবাংলো মোড়ে বেধড়ক মারে মাথা ফাটল চালকের। ভাঙচুর করা হল সরকারি বাস। নিমতিতায় পুলিশ ও বন্‌ধ সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটল। এ দিকে, জঙ্গিপুর থেকে ফরাক্কা— মুর্শিদাবাদের উত্তরাঞ্চল দাপিয়ে বেড়াল পুলিশ ও শাসক দলের মিছিল ও বাইক বাহিনী। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, এত কিছু করার পরেও সাধারণ মানুষ তাঁদের পাশে থাকায় বন্‌ধ সফল।

রঘুনাথগঞ্জে অবরোধ সরিয়ে পুলিশ অফিসে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিলেও কর্মীরা অফিসে না আসায় ঢোকায় সমস্ত ডাকঘর, ব্যাঙ্ক, জীবনবিমা-সহ বেশির ভাগ সরকারি অফিসে কাজই হয়নি। দোকানপাট বেশির ভাগই ছিল বন্ধ। কোথাও কোথাও হাজিরা খাতায় সই করতে শিক্ষকেরা স্কুলগুলিতে ঢুকলেও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। এসডিও, বিডিও অফিস-সহ রাজ্য সরকারের কিছু অফিস পুলিশ পাহারয় খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা! ফলে সেখানেও কাজ হয়নি। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ছিল সুনসান। বেসরকারি বাস রাস্তায় না নামলেও ছোটগাড়ি অনেক জায়গাতেই চলেছে।

এ দিন সকালে ফরাক্কায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধের চেষ্টা করে বন্‌ধ সমর্থকেরা। পুলিশ সরিয়ে দেওয়ায় রাস্তার পাশে মাইক লাগিয়ে দিনভর পথসভা করে সিপিএম। ধুলিয়ানে ডাকবাংলো মোড় অবরোধ করে বাম সমর্থকেরা। এই সময় উত্তরবঙ্গ পরিবহণের একটি সরকারি বাস এলে ভাঙচুর চালায় অবরোধকারীরা। হামলার মুখে পড়েন লরি চালক প্রণত শঙ্কর রাও। তাঁকে লরি থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করে বাম সমর্থকেরা। রক্তাক্ত অবস্থায় তারাপুর কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালে মাথায় ছ’টি সেলাই পড়ে।

ধুলিয়ানের শিবমন্দির এলাকায় বাম সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূলের হাতাহাতি হয়। বন্‌ধের প্রভাব সেখানে কিছুটা কম ছিল। সুতির দফাহাটে রেজিস্ট্রি অফিস খোলা নিয়ে বন্‌ধ সমর্থকদের সঙ্গে গোলমাল হয় পুলিশের। এই সময় দ্রুতগতি চলা মারুতি গাড়ির ধাক্কায় জখম হয় ছ’বছরের শিশু চাঁদনি রায়-সহ পাঁচ জন। পুলিশ জানায়, রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকবে এই আশায় গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে এই বিপত্তি হয়। এ দিন জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালের বহির্বিভাগ, কি অন্তর্বিভাগে অন্য দিনের তুলনায় ১০ শতাংশ মানুষও আসেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM MLA MP Baharampur congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE