শীতের মেলায় পিঠের বিকিকিনি। নিজস্ব চিত্র
শহরের মাঠে বসেছে শীতের মেলা। কনকনে ঠান্ডায় কোনও স্টলেই তেমন লোকজন নেই। কেবল দু’টি স্টলে ভিড়। কিছু লোকজন সামিয়ানার নীচে বসে অনুষ্ঠান দেখছেন। বাকিরা ভিড় জমিয়েছেন ওই দু’টি পিঠেপুলির স্টলে।
কাঠের উনুন জ্বেলে সেখানে গরম গরম ভেজে দেওয়া হচ্ছে পাটিসাপটা থেকে ভাপা পিঠে। নলেন গুড়ের পায়েস থেকে চন্দ্রপুলি, ভাজা পিঠে থেকে রসবড়া— কী নেই সেখানে! মেলায় আসা লোকজন লাইন দিয়ে সে সব খাচ্ছেনও। দাম পাঁচ টাকা থেকে পনেরো টাকা। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের জেলা সদর হোক কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম, বইমেলা থেকে শিল্পমেলা, বাউলমেলা থেকে গ্রামীণ মেলা— সর্বত্রই হইহই করে বিকোচ্ছে পিঠেপুলি। তাঁতের কারবার উঠে যাওয়ার পরে ট্রেনে ফেরি, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেছেন নবদ্বীপের বিজন বিশ্বাস। বছর কয়েক আগে বাড়ির পাশে মেলার মাঠে পরীক্ষামূলক ভাবে তাঁর মা আর স্ত্রীর তৈরি কিছু ঘরোয়া খাবার নিয়ে বিক্রি করতে বসেছিলেন। বিক্রির বহর দেখে সিদ্ধান্ত নেন, পিঠেপুলির ব্যবসা করবেন। সেই শুরু। এখন করিমপুর থেকে কলকাতা যে কোন জায়গায় মেলা হলেই বিশ্বাস দম্পতি চলে যান পিঠেপুলির সরঞ্জাম নিয়ে। তাঁর কথায়, “মেলা যেমনই হোক, শীতকালে পিঠেপুলির মার নেই।”
অথচ কয়েক দশক আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম। পৌষ সংক্রান্তিতে গোবর নিকানো পরিষ্কার উঠোনে তুলসী মন্দিরের সামনে আঁকা হোত চালের গুঁড়োর বাহারি নকশা। ধুয়েমুছে ঢেঁকিতে মাখানো হতো সিঁদুর। উঠোন জুড়ে পিটুলির গোলায় আঁকা হতো আলপনা। ও দিকে থরে থরে সাজানো আস্কে পিঠে, গোকুল পিঠে, ভাজা পিঠে, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, পাটি সাপটা, সরু চাকলি, রসবড়ার মতো নানা পদ।
মকরসংক্রান্তির ভোরে স্নান সেরে পাটভাঙা শাড়িতে পৌষ আগলাতেন বাড়ির মহিলারা। কোথাও মহিলারা গাইতেন ‘পৌষ মাস লক্ষী মাস না যাইও ছড়িয়া, ছেলেপিলেকে ভাত দেব খান্দা ভরিয়া’। এমন ছবি এখন ধূসর। গান না ফিরলেও মেলার হাত ধরে ফিরছে বহু পিঠেপুলির পদ। মেলার মাঠ কিংবা হালের ‘খাদ্য উৎসবের’ আসরে পিঠেপুলির তুমুল চাহিদা।
জেলার বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা আচার, জেলির সঙ্গে বিক্রি করছেন হরেক রকম পিঠেপুলির পদ। সম্প্রতি বহরমপুর এফইউসি ময়দানে হল খাদি মেলা। উপচে পড়া ভিড়ে মেলার মাঠে পাটিসাপটা খেতে খেতে স্কুল শিক্ষিকা মালবিকা হাজরা বলেন, ‘‘সময়ের অভাবে তৈরি করতে পারি না। ভাগ্যিস মেলায় মিলছে!’’
নবদ্বীপে সত্তরের দশকে দোকানে ভাজাপিঠে বিক্রি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়াত মিষ্টান্ন শিল্পী শিবু সেন। সেই ধারা মেনে এখন শহরের বেশির ভাগ দোকানে মেলে পিঠে। বহরমপুরের ব্যবসায়ী নিলু সাহা বলেন, “ভাবিনি মা মাসির হাতে তৈরি হেঁশেলের খাবার দোকানে বিক্রি হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy