ওপার বাংলার প্রথা মেনে আজও পয়লা বৈশাখে দুধ ওথলানো হয়। করিমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
বাংলা নববর্ষের উৎসব শুরু হয়ে যেত চৈত্র সংক্রান্তির কাকভোরেই। ভৈরব কিংবা কীর্তিনাশায় স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে সকলেই হাজির হয়ে যেতেন বাড়ির ঠাকুর ঘরে। তখন পাড়ায় পাড়ায় এত মঠ-মন্দির ছিল না। তাই যে কোনও উৎসবে গৃহদেবতার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ঠাকুর ঘরে প্রদীপ, ধূপ জ্বালিয়ে ভাইয়ের হাতে বোন তুলে দিতেন যবের ছাতু। বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকেকে সে দিন যবের ছাতু খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বছরের শেষ বিকেলে কোনও নদী বা জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাস দিয়ে ছাতু উড়িয়ে বাড়ির মহিলারা একসঙ্গে বলতেন— ‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই।’ চৈত্রের শুকনো বাতাসে মেঠো পথের ধুলো আর ছাতু মিলেমিশে একাকার হয়ে ঢেকে দিত বছরের শেষ সূর্যকে। এ ভাবেই বাংলা পঞ্জিকার শেষ দিনে নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত ও পার বাংলায়।
১৩৭০ সালে বাপ-কাকার হাত ধরে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন কণক দাস। ঢাকার কলাকোপা গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে কণকদেবী তখন সবে আঠারোয় পা দিয়েছেন। এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই কণকদেবীর স্পষ্ট মনে আছে সেই নববর্ষের কথা। তিনি বলেন, “চৈত্র সংক্রান্তিকে আমার বলতাম ছাতু সংক্রান্তি। সে দিনের অনুষ্ঠান ছিল অনেকটা ভাইফোঁটার মতো। ভাইয়ের হাতে ছাতু দেওয়ার ওই অনুষ্ঠানকে বলা হত ভাই ছাতু।’’
খুলনা আর যশোরের সীমানায় সিদ্ধিপাশা গ্রাম। গ্রামের প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠবিহারী কর। সেই সময় তাঁদের ঘরে তৈরি কাপড়ের জন্য হাওড়া মঙ্গলাহাটের ক্রেতারা হা পিত্যেশ করে বসে থাকতেন। একান্নবর্তী কর পরিবারে প্রতিদিনই ত্রিশ করে পাত পড়ত দু’বেলা। গ্রামের বেশিরভাগ তাঁতি গোষ্ঠবিহারীর কাপড় বুনতেন। ফলে বাংলা নববর্ষে গোষ্ঠবিহারীর হালখাতার উৎসব ছিল দেখার মতো। সকালে গণেশ পুজো, লালকাপড়ে জড়ানো নতুন খাতায় সিঁদুর মাখানো টাকার ছাপ দেওয়া— সব এখনও চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পান গোষ্ঠবিহারীর ছোট মেয়ে বীণাপানিদেবী। ৮২ বছরের বীণাপানিদেবী বলছিলেন, “আমাদের বাড়ি ছিল ভৈরব নদের পাড়ে। ফলে প্রতিদিনই আমরা নদীতে স্নান করতাম। কিন্তু পয়লা বৈশাখের সকালে বাড়ির সবাই মিলে খুব ভোরে স্নানের মজাটাই ছিল অন্যরকম। নববর্ষের সময় বাড়িতে কলকাতার নাম করা দোকানের মিষ্টি আসত। মা, ঠাকুমারা বাড়িতেই মিষ্টি তৈরি করতেন। পয়লা বৈশাখের দুপুরে সিদ্ধিপাশার অর্ধেক লোকের নিমন্ত্রণ থাকত আমাদের বাড়ি। যাচাই হত কলকাতার মিষ্টি, নাকি বাড়ির মিষ্টি— কোন দিকে পাল্লা ভারি।”
দেশভাগের অনেক আগেই পরিবারের সকলের সঙ্গে কলকাতায় ছকু খানসামা লেনে চলে আসেন বীণাপানিদেবী। বিয়ের পর থেকে নবদ্বীপ। পয়লা বৈশাখ এলেই এখনও মনে পড়ে যায় যশোরের মাথা বড় কইমাছের ‘তেল কই’ বা ইলিশের মাথা দিয়ে ‘মুড়িঘণ্টের’ সেই রান্নার কথা। আগের দিন থেকেই গোষ্ঠবিহারীর নির্দেশে পুকুরে জাল নিয়ে নেমে পড়তেন জেলেরা। প্রত্যেকের পাতে সমান মাপের কই দিতে হবে। সঙ্গে ইলিশের মাথা আর গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট। ডুমো ডুমো করে কাটা আলু। নামানোর আগে ঘি, গরমমশলা। ওদিকে বড় বড় পাথরের ‘খোড়ায়’ ঘরে পাতা সাদা দই। বীণাপানিদেবীর কথায়, ‘‘ওখানে নববর্ষ যে ভাবে পালন করা হত তা এখানে বসে কল্পনাই করা যাবে না। বিজয়া দশমীর থেকেও বড় করে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হত।’’
তবে সকলের স্মৃতিতে ফেলে আসা নববর্ষ কিন্তু সবসময় সুখের নয়। রংপুরের বাসিন্দা ছিলেন যূথিকা সাহা। বাবা সুবোধ সাহা ছিলেন রংপুরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ১৯৭২ সালে ওপার বাংলা ছেড়ে আসতে হয় যূথিকাদেবীকে। তখন তিনি কারমেল কলেজে আই এ পড়ছেন। যূথিকাদেবী জানান, নববর্ষের সকাল ওপার বাংলায় চিরকালই অন্যরকম তাৎপর্য বহন করত। কিন্তু যে বছর ওই দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেই বছরের নববর্ষের স্মৃতি কোনদিন ভোলার নয়। দিনটা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। ২৫ মার্চ। রাতে গ্রামে সেনা ঢুকল। তারপরের ক’টা দিন ছিল চরম আতঙ্কের। সেখান থেকে তাঁরা চলে আসেন ব্রাহ্মনীকুণ্ডা গ্রামে। এরমধ্যেই এল পয়লা বৈশাখ। যূথিকাদেবী বলেন, ‘‘ব্রাহ্মণীকুণ্ডা গ্রামের মানুষজন তাঁদের মতো করে সে বারেও নববর্ষ পালন করেছিলেন। খাওয়া দাওয়া, নতুন জামাকাপড়, আনন্দ, হাসি, গান। সব ছিল ওঁদের জন্য। আমরা কেবল অনাহূতের মতো দূর থেকে শুধু দেখেছিলাম। তার ক’দিন পড়েই আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy