Advertisement
১১ নভেম্বর ২০২৪
দুয়ারে দোল: নেশা

শিলে কলিজা বেটে আঁখিতে ঘোর

জনা পঁচিশ কবি-সাহিত্যিক জড়ো হয়েছেন বহরমপুর শহরের মোহনের মোড়ে রৌরব পত্রিকার ছাপাখানায়। হাতে-হাতে হ্যারিকেন। গলা থেকে ঝুলছে পোস্টার— ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। সবার ঝোলাব্যাগে সিদ্ধির শরবত।

অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না।

অঙ্কন: অর্ঘ্য মান্না।

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
বহরমপুর ও নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭ ০১:৫৯
Share: Save:

জনা পঁচিশ কবি-সাহিত্যিক জড়ো হয়েছেন বহরমপুর শহরের মোহনের মোড়ে রৌরব পত্রিকার ছাপাখানায়। হাতে-হাতে হ্যারিকেন। গলা থেকে ঝুলছে পোস্টার— ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। সবার ঝোলাব্যাগে সিদ্ধির শরবত।

‘‘সব টইটম্বুর। মোহনের মোড় থেকে টলোমলো পায়ে চলেছি, গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। সাত কিলোমিটার দূরে কাশিমবাজারে বয়োজ্যেষ্ঠ কবি তাপস ঘোষের বাড়ি। সেখানে পৌঁছতে-পৌঁছতে আবির, সিদ্ধি— সব শেষ।’’

বক্তা মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সমীরণ ঘোষ। পেশায় বাস্তুকার হলেও আদ্যোপান্ত কবি। তাঁর যৌবনের এই গল্পটারই বয়স পঁয়ত্রিশ বছর।

তখন মিক্সির যুগ আসেনি। হেঁইও শিলে বাটা হত সিদ্ধি পাতা। তা মিহি হলে পিতলের পাত্রে মিষ্টিদই, সন্দেশ, দুধ দিয়ে ঘোঁটো ভাল করে। উপরে ছড়িয়ে দাও কুচি কাজু-পেস্তা। দিল চাইলে ‘রুহ্ আফজা’র গুলাব সুগন্ধি মেশাতে পারো ঈষৎ। বড় রুস্তম হলে আবার আরও নানা মাস্তানি কারবার। শিলেই সিদ্ধি পাতার সঙ্গে বাটতে হবে নারকেলের শিকড়। যতই লোকে বলুক ‘করিস না রে করিস না, বিষিয়ে যাবে’— কানে তুললে চলবে না। বরং চোখ মটকে হেসে শিলে তেড়ে ঘষতে হবে তামার পয়সা, যাতে ‘ধক’ আরও বাড়ে। হয়ে-টয়ে গেলে হালকা সবজেটে সাদা তরলে ছড়িয়ে দাও বরফকুচো, ঠান্ডাই তৈয়ার! তার পর গ্লাসে গ্লাসে— আহ্!

খেল শুরু হবে একটু পরেই। কেউ টানা হাসবে, কেউ হু-হু কাঁদবে, কেউ বা চেপে ধরবে এমন কারও হাত যার দিকে চোখ তুলে তাকানোও মানা।

আরও পড়ুন: পুলিশের বাড়তি নজরদারি দোলে

বাসন্তী বর্ষণে দোল এ বার খানিক ভিজে-ভিজে। বাতাসে শীত-শীত, যাকে বলে শুদ্ধ ‘আবগারি ওয়েদার’। অনেক ছিপিই টকাটক খুলে যাবে মেঘের ফাঁকে রোদ একটু তাতলেই। বার্লির স্বাদু আরক, গম-যবের সোনা ঝলমল, রাশিয়ান ভালুকের পশম, জামাইকা-চোঁয়ানো গুড়জল।

কিন্তু দোল আসলে কারণবারির উৎসব নয়। ছিলিম-তাতানো শিবের প্রসাদীও চলে না। বরং গোটা উত্তর ভারত জুড়ে সিদ্ধি ওরফে ভাঙের হরিদ্রাভ শ্বেতবর্ণ লাভাস্রোত বয় দিনভর— ‘লঙ্গা ইলাইচি কা বিড়া লাগায়া/ ছবে গোরি কা ইয়ার বালাম তরসে... হোলি হ্যায়!’

নেশা যেমন জুত, হ্যাপাও অনেক। নিয়মই ছিল, পাড়ার চিলতে মাঠে ন্যাড়াপোড়া শেষ হলেই যে যার কাজে লেগে যাবে। সকালেই নবদ্বীপ থেকে নদী পেরিয়ে বর্ধমানের নিদয়া গ্রামে গিয়ে ভাঙের পাতা নিয়ে আসা হয়ে গিয়েছে। সন্ধেয় কেউ যাচ্ছে দুধ-দই কিনতে। কেউ কুমোরবাড়ি থেকে লম্বাটে মাটির গ্লাস আনছে। চল্লিশ পেরোনো জয়ন্ত সাহা হেসে বলেন “পানপাত্র নয় ভাংপাত্র, বুঝলেন কি না!’’ বহরমপুরের টেক্সটাইল মোড়ে বাবির ঠেকে সকাল থেকেই সিদ্ধির ফোয়ারা ছুটত বছর পঁচিশ আগেও, মনে পড়ে দর্জি তপন কর্মকারের।

বঙ্গদেশে দোল উৎসবের অন্যতম কেন্দ্র বৈষ্ণব সমাজে কিন্তু এ সব নেশা অচল। সেখানে অন্য বন্দোবস্ত। মৃদু হেসে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বাবাজি বলেন, ‘‘সংকীর্তনের চেয়ে বড় নেশা আর কী আছে? ওতে যা ঘোর লাগে, তা যে আর জন্মে কাটে না!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Holi Memories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE