Advertisement
১৮ মে ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

প্রাণ-হাতে ভোট করিয়ে ফেরাই দায়িত্ব ওঁদের

তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা, জনবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা চক পানপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৮
Share: Save:

রাত তখন পৌনে ১১টা। সবে চোখ লেগে এসেছে। বাইরে প্রবল হট্টগোলের আওয়াজ। স্কুলঘরের জানলা খুলে চক্ষু চড়কগাছ পুলক গোস্বামীর। প্রায় অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে রে-রে করে ছুটে আসছেশ’-তিনেক মানুষ!

তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা, জনবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা চক পানপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে পলকা ঘরের মধ্যে বসে ওই দৃশ্য দেখে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল চার শিক্ষকের। যাঁরা পঞ্চায়েত ভোটের কাজে গিয়েছিলেন ফুলিয়ার মূল ভূখণ্ড ছেড়ে ওইপ্রত্যন্ত গ্রামে।

উত্তেজিত জনতার প্রবল লাথির ধাক্কায় দরজা ভেঙে পড়ার আগে খুলে দেওয়া হল দরজা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ঘিরে ধরে গালিগালাজ শুরু করে একদল মানুষ। ততক্ষণে বাইরে পুরো স্কুল ঘিরে ফেলেছে কয়েকশো মানুষ। ওই ভোটকর্মীদের দলে ছিলেন নবদ্বীপের বাসিন্দা তথা স্কুল শিক্ষক পুলক গোস্বামী। তিনি বলেন, “গ্রামবাসীদের ক্ষোভ— কেন আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া ভোট করাতে গিয়েছি। বাহিনী ছাড়া ভোট হবে না, এই ছিল দাবি।’’

তাঁর কথায়, ‘‘বিষয়টিতে যে আমাদের কোনও হাত নেই, তা বোঝাতে গেলে বলা হয়— ‘কেটে-পুঁতে ফেললেও কেউ টের পাবে না’! এই হুমকির মধ্যে বসে আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করি সেক্টর অফিসারের সঙ্গে। সঙ্গী ছিলেন এক জন মাঝবয়সী বন্দুকধারী রাজ্য পুলিশ।” পরে রাত ২টোর সময়ে জনাদশেকের কেন্দ্রীয় বাহিনী গিয়ে গ্রামের মানুষের হাত থেকে ওই ভোটকর্মীদের উদ্ধার করে। পরের দিন ভোট অবশ্য নির্বিঘ্নে হয়েছিল।

তবে ভিন্ন অভিজ্ঞতা নাকাশিপাড়ার ভোট করাতে যাওয়া আর এক শিক্ষকের। ভোট শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল শুরু হয় শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। সশস্ত্র দুই দলের মধ্যে পড়ে প্রাণভয়ে বুথ ছেড়ে পালাতে হয় তাঁদের। প্রথম পোলিং অফিসার হিসাবে নিযুক্ত ওই শিক্ষককে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে উঠে যেতে বাধ্য করা হয় বলে দাবি। দুপুরের আগেই কার্যত ভোটের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় ওই ইংরেজি শিক্ষকের। এখনও আতঙ্ক থেকে বেরতে পারেননি তিনি।

কৃষ্ণনগরের শিক্ষক দীনবন্ধু মোদকের দুর্ভোগ শুরু হয় কালীগঞ্জের ডিসিআরসি থেকেই। চূড়ান্ত অব্যবস্থার কারণে ভরদুপুরে পাগলাচণ্ডী স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে পৌঁছতে হয় পানিঘাটা হাইস্কুলে। ভোটকর্মীদের জিনিসপত্র দেওয়া হচ্ছিল যেখান থেকে, সেই পুরো জায়গা ছিল জল-কাদায় ভরা। দীনবন্ধু বলেন, “ভোটের জিনিসপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, তার কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। কাগজপত্র হাতে পেয়ে যেখানে বসে তা মেলাতে দেওয়া হয়, জল-কাদায় ভরা সে জায়গায় বসে আমাদের সকলের পোশাক গেল ভিজে। ওই অবস্থায় বাসে উঠলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে আছি। জানা গেল, কাদায় বাসের চাকা বসে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্রেন এনে বাস টেনে তুলতে হয়। এ সব করে আমরা যখন রওনা দিলাম, তত ক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।” তবে সৌভাগ্য এই যে, ভোটের দিনে কোনও সমস্যা হয়নি তাঁদের।

সারা দিন দারুণ পরিবেশে ভোট হয়েছিল চাপড়া ব্লকের আলফা অঞ্চলের ৫৬ এবং ৫৭ নম্বর বুথে। যদিও ভোটের দিনে ভোটকর্মীদের সুরক্ষার জন্য মাত্র দু’জন রাজ্য পুলিশ ছাড়া কেউ ছিল না। প্রিসাইডিং অফিসার দিগনগরের শিক্ষক সরোজ মণ্ডল বলেন, “ভোট শেষ। অন্য কাজ শেষ করে রওনা হওয়ার ঠিক আগে বাইরে হইহই শব্দ। খবর নিয়ে জানতে পারি, দুটো বুথ ঘিরে রেখেছে গ্রামের কয়েকশো মানুষ। জানা গেল, ওই দুই বুথের ব্যালট বাক্স লুট করার জন্য বাইক বাহিনী ঘুরছে। গ্রামবাসীরা তা হতে দেবেন না। তত ক্ষণে বাইকের প্রবল শব্দ। গ্রামের মানুষের সাফ কথা— কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া ব্যালট যাবে না।’’ অনেক রাতে তিন গাড়ি কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায়, বুকে করে ব্যালট বাক্স জড়িয়ে, প্রাণ-হাতে করে ফেরেন শিক্ষকেরা। পুরো সময় তাঁদের পাহারা দিয়েছিলেন গ্রামের মানুষ। যাঁদের বলছিলেন, ‘‘এ বার যখন ভোট দিতে পেরেছি, বাক্স লুট হতে দেব না কিছুতেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Election 2023 Nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE