Advertisement
১৬ মে ২০২৪

ব্যাঙ্কে পড়ে চারটে লাশ, দৌড়চ্ছে লালু

ভুলে যাওয়া সময়ের ডায়েরিতে হলদে পাতা ওড়ে, তাতে শুকনো রক্তের দাগ। এক সময়ে হইচই ফেলে দেওয়া খুন-জখমের ইতিবৃত্ত চুপ করে থাকে পুলিশ ফাইলে। নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এক দিন সংবাদের কেন্দ্রে চলে আসা আত্মীয়-পরিজন। কিনারা হয়েছে কি সব রহস্যের? ভুলে কি গিয়েছে সবাই? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। সে দিন রাত দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ লালু হঠাৎ অদ্ভূত আচরণ শুরু করে। কখনও পাড়ার মোড়ে ছুটে যাচ্ছে, তো কখনও ফিরে এসে ঢুকে পড়ছে ঘরের মধ্যে। কেউ কোন দিন এমনটা করতে দেখেনি তাকে।

সে দিন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। — ফাইল চিত্র

সে দিন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। — ফাইল চিত্র

গৌরব বিশ্বাস ও কল্লোল প্রামাণিক
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০২:৫২
Share: Save:

সেই রাতে লালু হঠাৎ খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল।

লালু পাড়ার কুকুর। গায়ের রং লালচে। যে যা দিত, তা-ই খেত। অচেনা লোক পাড়ায় ঢুকলে চেঁচিয়ে জানান দিত।

সে দিন রাত দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ লালু হঠাৎ অদ্ভূত আচরণ শুরু করে। কখনও পাড়ার মোড়ে ছুটে যাচ্ছে, তো কখনও ফিরে এসে ঢুকে পড়ছে ঘরের মধ্যে। কেউ কোন দিন এমনটা করতে দেখেনি তাকে।

অবশ্য দেখার মতো লোক রাস্তায় বেশি ছিলও না।

কার্তিকের প্রায় শেষ। কালীপুজো পার করে বাতাস সবে হিম হতে শুরু করেছে। ঘড়ির কাঁটা ন’টা পেরোতেই দোর এঁটেছে আনন্দপল্লি, ও পাশে নতুনপল্লিও। সীমান্ত ঘেঁষা করিমপুর বাজারে ক’দিন থেকেই সন্ধের পরে ভিড় পাতলা হচ্ছিল। আর সে দিন তো আবার বৃহস্পতিবার, সাপ্তাহিক বাজার বন্ধ। রাত নামতেই সুনসান। আলো জ্বলছিল শুধু বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ব্যাঙ্কে।

রোজই জ্বলে। আর বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রোজই বসে থাকে বছর নয়েকের অভিনব। তার বাবা, অরুণ মণ্ডল তো ওই ব্যাঙ্কেই রোজ কাজে যান। সে দিনও সে বসে ছিল। গায়ে জ্বর, খিদে পেয়েছে। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে আর হাই তুলছে ছেলেটা। তবু বাবা না এলে সে কিছুতেই খাবে না, ঘুমোবেও না।

সেই সন্ধে সাতটা থেকে নাগাড়ে মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে অভিনব— ‘বাবা এখনও আসছে না কেন?’’ মা অসীমাও বিরক্ত হয়ে এক বার বলে ফেলেছিলেন, ‘‘সত্যি বাপু, তোর বাবার কী যে এত রাজকার্য থাকে! দেখে গেল ছেলের শরীরটা ভাল নয়। তার পরেও বাড়ি আসার নাম নেই!’’

আসলে ব্যাঙ্কটায় লোক কম। প্রায় রোজই তাই সন্ধে পার করে হাতের কাজ সারেন কর্মীরা। ব্যাঙ্ক দোতলায়, সামনে কোলাপসিবল গেট বন্ধ। একতলায় সিঁড়ির মুখে আদ্ধেক নামানো শাটার। সামনে ঝুপসি গাছ আঁধার আরও বাড়িয়েছে। কিছু চেনা মুখ, বেশির ভাগই কারবারি, দিনে হয়তো সময় পান না, রাতে এসে এ কাজ-ও কাজ করিয়ে নিয়ে যেতেন।

সে দিনও তা-ই। চেনামুখ উঠে এসেছিল সিঁড়ি দিয়ে। কাজ ছিল। গেট খুলে দিয়েছিলেন রক্ষী। চেনামুখের পিছনে আরও কয়েকটা মুখ। নীচে ঝুপসি গাছের নীচে আরও কয়েকটা। ব্যাঙ্কের লকারে টাকা ছিল। ডেপুটি ম্যানেজারের কাছে চাবির গোছা ছিল। আগন্তুকদের হাতে চাকু ছিল। খানিক পরে মুখগুলো সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। উপরে পড়ে রইল চারটে লাশ। আরও এক জনের গলার নলি কাটা, তবু হৃদ্‌পিণ্ড ধুকপুক করছে।

আর খানিক বাদেই আনন্দপল্লিতে অস্থির হয়ে উঠল কুকুরটা! সে কি কিছু টের পেল? আশপাশে দিয়ে চলে গেল কি কেউ, যাদের গায়ে রক্তমাখা জামা, পকেটে রক্তমাখা ছুরি?

রাত গড়াচ্ছে।

নতুনপল্লির আনাচে-কানাচে বাকি সব ছাপিয়ে আরও জোরালো হচ্ছে ঝিঁঝিঁ-র ডাক। চাদর জড়িয়ে বিছানায় বসে থাকতে থাকতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অভিনব। অসীমা ছেলের ঘুম ভাঙাননি। ভেবেছিলেন, ওর বাবা ফিরলেই তুলে খাইয়ে দেবেন। চোখ দু’টো লেগে আসছিল তাঁরও। হঠাৎ তাঁর পাড়ার কুকুরগুলোও খেপে উঠল কেন? এত চিৎকার? চোর এল না কি? বুকটা কেঁপে উঠেছিল অসীমার।

খবরটা এল সাড়ে দশটা নাগাদ। কয়েক জন পড়শি এসে জানালেন— অরুণের বিপদ হয়েছে। হাসপাতালে যেতে হবে। পড়িমড়ি করে ছুটে গিয়ে দেখেন, হাসপাতালে পড়ে স্বামীর নিথর দেহ। পাশে আরও তিনটে লাশ। রক্তের আঁশটে গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। তার পর সব অন্ধকার। জ্ঞান ফিরলে অসীমা দেখেন, তাঁকে জড়িয়ে কাঁদছে ছেলে। আর খুঁজছে বাবাকে।

১২ নভেম্বর, ২০০৯।

চারটে লাশ ব্যাঙ্কের চার কর্মীর— মধুসূদন কর্মকার, প্রবীর মুখোপাধ্যায়, কাজল চক্রবর্তী এবং অরুণ মণ্ডল। বহরমপুরের বাসিন্দা মধুসূদন এবং পাঁশকুড়ার প্রবীর অফিসার। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কাজল চক্রবর্তীর বাড়ি স্থানীয় অভয়পুরে। নতুনপল্লির অরুণ অস্থায়ী কর্মী, জেনারেটর চালানো আর টুকটাক অন্য কাজের দায়িত্ব ছিল তাঁর। কাটা নলি নিয়ে তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসা ডেপুটি ম্যানেজার অমিত মল্লিক। ঠিক তিন দিন পরে, ১৬ নভেম্বর আসানসোলের হোটেল থেকে পুলিশ যাকে পাকড়াও করল, তার বাড়ি ওই আনন্দপল্লিতেই। যে রাস্তা দিয়ে অস্থির হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল লালু, তার পাশেই। নাম তাপস ঘোষাল, এত দিন দরাজহস্ত ব্যবসায়ী বলেই পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা তাকে চিনতেন। তার সঙ্গে ধরা পড়ল মুরুটিয়ার তাজপুরের আজাদ শেখও। সেই সময়ে করিমপুর ক্লাবের পাশে আজাদ তার দিদির লন্ড্রির দোকান সামলাত। ওই দিনেই বহরমপুর থেকে গ্রেফতার করা হল তাপসের স্ত্রী মানসীকেও। তিন জনকে জেরা করে পরের দিনই মুরুটিয়ার বারুইপুর থেকে ধরে আনা হল সিরাজ শেখ ও স্মরজিৎ শেখ নামে আরও দু’জনকে।

এর মধ্যে মানসী হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে আপাতত বাইরে। বাকি চার জন এখনও জেল হাজতে। মোট ১১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় সকলেরই সাক্ষ্য ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। বাকি রয়েছেন পুলিশ এবং সিআইডি-র দুই তদন্তকারী অফিসার। তাঁদের সাক্ষ্য হয়ে গেলেই রায় ঘোষণার দিন এগিয়ে আসবে।

পুলিশের দাবি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি সেরে খুনেরা রক্তমাখা জামাপ্যান্ট পরে আনন্দপল্লির রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। ঠিক তখনই অস্থির হয়ে উঠেছিল লালু। নিজের বাড়িতে ফিরে বালতির জল জামাকাপড় চুবিয়ে দেয় তাপস। তার পর স্নান সেরে বাইক নিয়ে বেরিয়ে ফের ব্যাঙ্কের সামনে চলে যায়। সেখান থেকে হাসপাতাল। সম্ভবত সে বুঝে নিতে চেয়েছিল, সবাই মৃত কি না। ডেপুটি ম্যানেজার যে বেঁচে আছেন, সেই খবরটা কানে আসতে ভিতরে-ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েছিল সে-ও। পরে সেই অমিত মল্লিকই পুলিশের কাছে তাঁর বয়ানে তাপস ঘোষালের নাম বলেন। সুস্থ হয়ে আদালতে এসে তার চোখে চোখ রেখে টানটান সাক্ষ্যও দিয়ে যান। যদিও পুরোটাই এখন আদালতে প্রমাণ হওয়া বাকি।

এর পরে কেটে গিয়েছে সাতটা বছর। বাবা-মায়ের হাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে যাওয়া অভিনব এখন ১৬ বছরের কিশোর। এর মধ্যে তার জীবনে আর একটা পরিবর্তন এসেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরের বছরেই, ২০১০-এ কিডনির রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন তার মা। দু’বছর সে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। এখন পৈতৃক বাড়িতে একাই থাকে সে, একেবারে একা। ক্লাস সেভেনে উঠেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সে করিমপুরে একটা দোকানে কাজ করে।

আইন, আদালত, পুলিশ, তদন্ত, মামলা— এ সব কথা শুনলেই ভীষণ বিরক্ত হয় অভিনব। দেওয়ালে টাঙানো অরুণ-অসীমার বাঁধানো ছবি। সে দিকে এক বার তাকিয়ে নিয়ে অভিনব বলে, ‘‘এখনও রাতে দরজার কড়া নাড়লে চমকে উঠি, জানেন! মনে হয়, বাবা বোধহয় বাড়ি ফিরল। তার পর ভুল ভাঙে। কান্না পায়... আচ্ছা, বাবাকে ওরা মারল কেন?’’

একা হয়ে গিয়েছেন তাপসের মা রানি ঘোষালও। বছর তিনেক আগে তাপসের বাবা মারা গিয়েছেন। জামিন পাওয়ার পরে একমাত্র মেয়ে নিয়ে বহরমপুরে বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছেন মানসী। বুড়ির সম্বল বলতে বাড়ির দু’টো ঘর ভাড়া দেওয়ার টাকা। বিছানা থেকে একদম উঠতে পারেন না। রোজ দু’বেলা ঠাকুরকে বলেন, ‘এ বার আমায় নিয়ে নাও।’

কেন এ ভাবে মরার কথা বলছেন?

আঁচলে চোখ চেপে ফুঁপিয়ে ওঠেন বৃদ্ধা, ‘‘ছেলের পাপের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে! এ ভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না...।’’ (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bank employee Murder crime karimpur nadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE