কৃষ্ণগোপাল রায়। নিজস্ব চিত্র।
কলেজ অন্ত প্রাণ তাঁর। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে যে দিন কলেজে পা রাখেন তখন কলেজের নিজস্ব ভবনও ছিল না। পরে ভবন হয়। সদ্য নির্মিত কলেজকে সাজাতে নিজেকে সঁপে দেন। একটু একটু করে গড়ে তোলেন পঠনপাঠনের পরিবেশ।
এমনও হয়েছে কলেজে না আসা পড়ুয়াদের নামের তালিকা তৈরি করে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাদের বাড়ি বাড়ি। আবার কখনও কলেজের পরীক্ষায় টুকলি করতে দেবেন না বলে অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফাও দিতে চেয়েছেন। কখনও আবার কলেজের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ক্লাস ঘরে বসিয়েছেন সিসিটিভি। পরীক্ষার সময় বহিরাগতদেরা যাতে কলেজে ঢুকতে না পরে তারজন্য দাঁড়িয়ে থেকেছেন প্রধান ফটকের সামনে। নিজের হাতে পরিচয়পত্র দেখে তবেই ঢুকতে দিয়েছেন পরীক্ষার্থীদের। তার এই নানা উদ্যোগ সহকর্মী-পড়ুয়াদের বাহবা কুড়িয়েছে, কখনও বা তিনি তাঁদের বিরাগভাজন হয়েছেন। কিন্তু বিদায় বেলায় সকলকে এক সুতোয় বেঁধে দিলেন। সকলের এক যোগে অনুরোধ, ‘‘চলে যাবেন না স্যার। আমরা অভিভাবকহীন হয়ে যাব।’’
সোমবার চাপড়া বাঙালঝি কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নিয়েছেন কৃষ্ণগোপাল রায়। তাঁর অবসরের দিন যতই এগিয়ে আসছিল ততই ছটফটানি শুরু হয়েছিল সহকর্মী-পড়ুয়াদের মধ্যে। সকলেই চেয়েছেন যে তাঁকে যে কোনও ভাবে ধরে রাখতে। কয়েক দিন আগে থেকেই কলেজের শিক্ষক, ছাত্র, অশিক্ষক কর্মীরা পরিচালন সমিতির কাছে আবেদন করেন কৃষ্ণগোপালবাবুকে কোনও ভাবে যেতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে তাঁর কাজের মেয়াদ বাড়াতে হবে। লিখিত ভাবেও আবেদন জমা পড়ে পরিচালন সমিতিতে। তা নিয়ে পরিচালন সমিতির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে বৈঠকও করেন। পরিচালন সমিতির সভাপতি অজিত তরফদার বলেন, ‘‘শুধু শিক্ষক বা ছাত্ররাই নয়। এলাকার মানুষও আবেদন করেন কৃষ্ণগোপালবাবুর থেকে যাওয়ার জন্য। কয়েকটা ক্লাব থেকেও আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো সরকারি নিয়মের বাইরে যেতে পারি না।’’ তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু যে মানুষটা নিজের হাতে করে পরম মমতায় একটু একটু করে কলেজটা তৈরি করলেন তাঁকে কি এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়? আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাঁকে ‘মেন্টর’ বা উপদেষ্টা হিসাবে থাকার জন্য অনুরোধ করেছি।’’
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় চাপড়া বাঙালঝি কলেজ। সে সময় কলেজের নিজস্ব কোনও ভবন ছিল না। ক্লাস হত পাশেই বাঙালঝি স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরে। ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ জন। পরের বছর এই কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন কৃষ্ণগোপাল রায়। তার আগে তিনি ঝাড়খণ্ডের সিধু কানু কলেজে অধ্যাপনা করতেন। পরের বছরে প্রায় সাড়ে বারো বিঘা জমির উপরে মাত্র ৩টি ঘর নিয়ে তৈরি হল কলেজের নতুন বাড়ি। এখন সেই কলেজে ক্লাস ঘরের সংখ্যা ২০টি। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। ৯টি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। ফুল আর বাহারি গাছে সাজিয়েছেন গোটা কলেজ চত্বর। আর সেই সঙ্গে একটি একটু করে তৈরি করেছেন পঠনপাঠনের পরিবেশ। আর শিক্ষক-শিক্ষিকা আর পড়ুয়াদের পারস্পারিক সম্পর্ক। সেটা করতে গিয়ে কখনও তিনি স্নেহশীল আবার কখনও কঠিন হতে হয়েছে তাঁকে।
২০১৪ সালে টুকতে দিতে না চাওয়া তাঁকে টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের নেতার হাতে তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন। এমনকী পরিচালন সমিতির কাছে পদত্যাগপত্রও জমা দেন। শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি সেই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তবে শর্ত দিয়েছিলেন তিনি যতদিন অধ্যক্ষ থাকবেন ততদিন তিনি কলেজে টুকলি করতে দেবে না। শর্ত দিয়েছিলেন ছাত্র সংসদের ছেলেদের প্রকাশে ক্ষমা চাইতে হবে। তার সেই শর্ত মানা হয়েছিল। সে দিন ছাত্র সংসদের যে সাধারণ সম্পাদক তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন আজ সেই নবাব শেখরাই কিনা কৃষ্ণগোপালবাবুকে রেখে দেওয়ার জন্য পরিচালন সমিতির কাছে আবেদন করেন। নবাবের কথায়, ‘‘কেন করব না বলতে পারেন। আমরা তো কাছ থেকে দেখেছি মানুষটা কী ভাবে কলেজের জন্য দিন রাত এক করে দিতেন। কলেজ-অন্তর প্রাণ ছিল মানুষটার। যেমন বকাবকি করতেন তেমনি স্নেহও করতেন।’’
কৃষ্ণগোপালবাবুর হাত থেকে সোমবার টিচার ইনচার্জ হিসাবে কলেজের দায়িত্ব নিয়েছেন গার্গী সেনগুপ্ত। তিনি আবার কলেজের টিচার কাউন্সিলের সম্পাদকও। তার কথায়, ‘‘পরিচালন সমিতির কাছে আবেদন করেছিলাম যে কৃষ্ণগোপালববুর মেয়াদ যদি বাড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সরকরি নিয়মে সেটা সম্ভব নয়। তবুও আমরা চেয়েছি অন্য কোনও ভাবে যাদি তাকে কলেজের সঙ্গে ধরে রাখা যায়।’’ তিনি বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি তিনি পাশে সবসময় থাকবেন। মানুষটা কলেজটাকে যে ভেবে ভালবাসতেন তাতে আমাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি থাকতে পারবেন না।’’
সবাইতো চাইছে। কিন্তু তিনি নিজে কি চাইছেন? মঙ্গলবার চাপড়া ছেড়ে বরানগরে পরিবারের কাছে চলে যাওয়ার আগে তিনি বলে যান, ‘‘এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ায় আমি গর্বিত। কিন্তু একটু ভাবতে সময় দিন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy