প্রহৃত পুলিশকর্মী রবিউল ইসলাম।
পুলিশকে মারধর ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনার ২৪ ঘন্টা পরেও অভিযুক্ত দের গ্রেফতার করতে পারল না পুলিশ। বিশ্বকর্মা পুজোর চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে বুধবার সকালে বহরমপুরের পঞ্চাননতলা রেলগেটের কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে ব্যাপক যানজট হয়। অভিযোগ, ওই যানজট মুক্ত করতে বহরমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত টাউন-সাব ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম-সহ তিন জন পুলিশকর্মী ঘটনাস্থলে গেলে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা কাঠ-বাঁশ-লাঠি দিয়ে তাঁদের বেধড়ক মারধর করে। পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছোড়া হয়। উর্দিতে কাদা লেপে দেওয়ার পাশাপাশি গাড়ি ভাঙচুরও করা হয়। ওই তাণ্ডবে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। জখম চার পুলিশ কর্মী মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সা করানো হয়।
ঘটনার পরেই জেলা পুলিশ সুপার হুমাযুন কবীর জানান ‘পুলিশ কর্মী আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হবে’। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য বলেই কী তাদের গ্রেফতার করতে ক্ষেত্রে পুলিশ উদাসীন?
মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “ঘটনার তদন্ত চলছে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত দোষী কারা, তা জানা যাচ্ছে না। তদন্তে প্রমাণিত হলেই দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হবে।” ওই ঘটনায় জড়িত সুনির্দিষ্ট ১৩ জন এবং আরও ১৫০-২০০ জনের জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৩, ৩৩২, ৩৮৪, ৩৭৯, ৪২৭ ও ৩৪ নম্বর ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল থেকে বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে পণ্যবাহী লরি দাঁড় করিয়ে চাঁদা তুলছিল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন অনুমোদিত মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূল ট্রাক ড্রাইভার অ্যান্ড হেল্পার ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদস্যেরা। ফলে ওই রাস্তায় ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। ওই যানজট মুক্ত করতে গিয়েই আক্রান্ত হন বহরমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত টাউন সাব-ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম, কনস্টেবল মোজাম্মত্ হোসেন, সিভিক পুলিশ রবীন পাল ও কানন ভট্টাচার্য এবং চালক মওলা বক্স মোল্লা।
বুধবার পুলিশের সঙ্গে বচসা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, ঘটনার দিন যানজটের কারণে গাড়ি নিয়ে রেলগেট পর্যন্ত যেতে পারেনি পুলিশের জিপ। একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে দু’জন পুলিশ কর্মী হেঁটে যান। তখন একটি লরি দাঁড় করিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা হচ্ছিল। তাদের চাঁদা তুলতে নিষেধ করতেই চাঁদা আদায়কারীরা ওই দু’জন পুলিশ কর্মীকে ঘিরে ধরে মারধরের চেষ্টা করে। তখন টাউন-সাব ইন্সপেক্টর ও অন্য এক পুলিশ কর্মী গাড়ি থেকে নেমে চাঁদা আদায়কারীদের কাছে পৌঁছাতেই লাঠি-কাঠ-বাঁশ দিয়ে তাঁদের মারধর শুরু করে। পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছুড়তে থাকে তারা। তার মধ্যে পুলিশ এক জন চাঁদা আদায়কারীকে ধরে ফেললেও ধস্তাধস্তি করে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনা প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত টাউন-সাব ইন্সপেক্টরের সংক্ষিপ্ত জবাব, “কোনরকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছি।”
শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের ওই ইউনিয়নের সম্পাদক তাপস বিশ্বাস বলেন, “কোনও পুলিশ কর্মীকে মারধর বা পুলিশের গাড়ি আমরা ভাঙচুর করিনি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জনতা ও বিভিন্ন গাড়ির চালক-খালাসি গাড়ি ভাঙচুর করতে পারে। কিন্তু ওই ঘটনায় আমরা জড়িত নই।” উল্টে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি ব লেন, “রানা চক্রবর্তী নামে আমাদের এক জন সদস্য-চালক ভাড়া পেয়ে লরি বের করছিল। সেই সময়ে ওই রাস্তায় যানজট হওয়ায় ওই টাউন-সাব ইন্সপেক্টর লরি থেকে নামিয়ে ওই চালককে রাস্তায় ফেলে মারধর করেছে। আমরা ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি।” পাল্টা ওই টাউন সাব-ইন্সপেক্টর বলেন, “রানা চক্রবর্তী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা তুলছিল। পুলিশ তাকে ধরতেই ধস্তাধস্তি করে সে হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তখনই পালাতে গিয়ে মোটরবাইকের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। তার পরেই ওই ব্যক্তি রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হওয়ার ভান করে। কোনও মারধরের ঘটনা ঘটেনি। উল্টে আমরা কোনও ভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছি। নইলে মারা পড়তাম।”
ঘটনার পরে শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা পথ অবরোধ করে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। ততক্ষণে খবর পেয়ে বহরমপুর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সেই সঙ্গে কমব্যাট ফোর্স ও র্যাফ এসে অবরোধ তুলে দেয়।
আইএনটিইউসি অনুমোদিত মুর্শিদাবাদ জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে লিয়াকত আলি বলেন, “পুলিশকে মারধর করে, তাদের জিপ ভাঙচুর করে যারা পুলিশের চোখে-মুখে কাদা ছিটিয়ে দেওয়া থেকে পুলিশের উর্দিতে কাদা লেপে দিল, তারাই আবার পথ অবরোধ করে নাটকও করল।”
তাপসবাবুর অভিযোগ, “আমাদের সংগঠনকে দুর্বল করতে কংগ্রেসের হয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে কাজ করছে বহরমপুর থানার কয়েক জন নিচু তলার পুলিশ কর্মী।” লিয়াকত বলেন, “শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা চাঁদা তোলার নামে জুলুমবাজি করছিল। পুলিশ এসে ওই জুলুমবাজি বন্ধ করতেই তৃণমূলের ওই সংগঠনের লোকজন লাঠি-বাঁশ-কাঠ নিয়ে যে ভাবে পুলিশের দিকে তেড়ে গিয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা। পুলিশ বাধ্য হয় পঞ্চাননতলা দিয়ে পালিয়ে যেতে। এ দিনের ঘটনা পুলিশের কাছেও লজ্জার!”
তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা কার্যকরী সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেন, “পুলিশকে মারধর করা বিষয়টি কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। যাদের নেতৃত্বে ওই ঘটনা ঘটেছে তাদের অবিলম্বে ছাঁটাই করা উচিত।” তিনি বলেন, “তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নাম করে ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি জেলা নেতৃত্বের নজরে আছে কি না আমার জানা নেই। তবে রাস্তা আটকেযানজট তৈরি করে চাঁদা তুলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির মুখে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের হেনস্থা করলে পুলিশের মনোবল তলানিতে এসে ঠেকবে। এতে আমাদের সকলেরই ক্ষতি।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy