Advertisement
১৮ মে ২০২৪

নগদ কই, নোট বাতিলের ধাক্কায় ভাঙছে জোড়াতালির বিনিময় প্রথাও

নোট বাতিলের ধাক্কা সামলাতে বিনিময় প্রথা চালু করে শিরোনামে এসেছিল বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম শালজোড়। এক মাস পরেও নগদের জোগান স্বাভাবিক না হওয়ায় সেই জো়ড়াতালির ব্যবস্থাও এ বার ভেঙে পড়ার মুখে!

এ ভাবেও আর কত দিন? —নিজস্ব চিত্র

এ ভাবেও আর কত দিন? —নিজস্ব চিত্র

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪১
Share: Save:

নোট বাতিলের ধাক্কা সামলাতে বিনিময় প্রথা চালু করে শিরোনামে এসেছিল বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম শালজোড়। এক মাস পরেও নগদের জোগান স্বাভাবিক না হওয়ায় সেই জো়ড়াতালির ব্যবস্থাও এ বার ভেঙে পড়ার মুখে!

ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেল, ধানের মাধ্যমে যে বিনিময় প্রথা আঁকড়ে হেঁশেলে হাঁড়ি চড়ছিল, তা প্রায় অকেজো হতে চলেছে। ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নোট বাতিলের ঘোষণার পরে যে ধান ছিল ১০ টাকা কিলো, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৮ টাকায়। গ্রামবাসীর প্রশ্ন, ‘‘আর তো পেট চলছে না! কবে সব কিছু আবার আগের মতো হবে!’’

খয়রাশোল ব্লকের লোকপুর পঞ্চায়েতের এই গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। সবচেয়ে কাছের বাসস্টপ আট কিলোমিটার দূরে। বাকি রাস্তা ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভর্তি। ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘরও আট কিলোমিটারের আগে নয়। গ্রামে ৮০টি পরিবার। অধিকাংশ কৃষিজীবী, বাকিরা খেতমজুর। অনেকেরই ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট নেই। ‘পেটিএম’-এর নামও শোনেননি।

সচল নোটের অভাবে অর্থনীতির এই টালমাটাল সময়ে এগিয়ে আসেন গ্রামেরই দুই ক্ষুদ্র মুদি দোকানি আব্দুল গনি আর তাহসেনা বিবি। ১০ টাকা কিলো দরে ধানের বদলে নুন, তেল, মশলা কিনে পেট চালাচ্ছিলেন গ্রামের মানুষ। কিন্তু নোট বাতিলের এক মাস পরে পরিস্থিতি আরও
ঘোরালো হয়েছে।

এখনও গ্রামে বিনিময় প্রথা চলছে। কিন্তু তা আর বেশি দিন টানা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন গনির স্ত্রী নুরনেহার বিবি। এ দিন তিনি জানান, ধানের বদলে ঝাড়খণ্ডের দোকান থেকে জিনিসপত্র মিলছিল। এখন তা-ও বন্ধ হতে বসেছে। দিন দু’য়েক আগেই বাগডহরি ও ভালকো— ঝাড়খাণ্ডের দু’টি গ্রামের মহাজনেরা জানিয়ে দিয়েছেন, আর ধান নিতে পারবেন না। নগদ টাকা চাই। ‘‘এখন আমরাই বা ধানের বদলে জিনিস দেব কী করে?’’— প্রশ্ন নুরনেহারের। একই কথা তাহসেনা বিবিরও।

নগদের জোগান কী ভাবে হবে সে চিন্তায় ঘুম উড়েছে গ্রামের আব্দুল জলিল, মহম্মদ নুরুল আবসারদের। জানাচ্ছেন, বছরে দু’বার ধান হয় তাঁদের জমিতে। বাড়িতে পেট চালানোর মতো কিছুটা রেখে বাকিটা খয়রাশোলের লোকপুরে ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে নগদের জোগাড় করেন তাঁরা। কিন্তু এ বার নগদের অভাব থাকায় ব্যবসায়ীরা ধান কিনছেন না। কেবল অচল নোট নিলে কেনার কথা বলছেন। গাড়ি ভাড়া করে ১৬ কিলোমিটার দূরে ব্লক সদর খয়রাশোলে গিয়ে ধান বেচার মতো সঙ্গতি বা নগদ তাঁদের নেই।

গ্রামের কৃষ্ণ বাউড়ি ও তাঁর স্ত্রী ছবিদেবী খেতমজুর হিসেবে খাটেন। জানালেন, নোট-আকালের আগে দৈনিক মজুরি পেতেন ১৩০ টাকা। কিন্তু যাঁর হয়ে খাটেন, সেই মহাজনও নগদের অভাবে তাঁদের দিনে ১৮-১৯ কিলো ধান দিচ্ছেন। কিন্তু গ্রামের দোকানে সেই ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।

গ্রামীণ অর্থনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতির কথা কানে গিয়েছে প্রশাসনের। বিডিও তারকনাথ চন্দ্র বলেন, ‘‘দেখছি, কী করা যায়।’’

কিন্তু সে আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না শালজোড়ের গৃহবধূ ইন্দিরা বাউড়ি, তরুলা বাউড়িরা। ধানের পুঁটুলি হাতে গনির দোকানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘ধান দিয়েও জিনিস কিনতে না পারলে হাঁড়ি চড়বে কী করে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cash Demonetisation Market Notes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE