একই রাস্তার দু’টি অংশ মেরামতি নিয়ে পূর্ত দফতর এবং জেলাপরিষদের মধ্যে খরচ-বরাদ্দে বিরাট ফারাক সামনে এসে পড়ায় অনিয়মের অভিযোগ ঢাকতে পূর্ত দফতরের কাজে বাধা দিয়ে জেলাপরিষদের সভাধিপতি ললিতা টিগ্গা নবান্নের তোপের মুখে পড়লেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি এলাকায় জেলাপরিষদের রাস্তা মেরামতির কাজ শুরু করে পূর্ত দফতর। হিলি বাস স্ট্যান্ড থেকে চোদ্দো হাত কালী মন্দির হয়ে পশ্চিম আপতোর পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে অমূল্য বিশ্বাসের দোকান থেকে নবদ্বীপ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মিটার রাস্তা মেরামতি করছে জেলাপরিষদ। জেলা পরিষদ ওই ৬০০ মিটার রাস্তা মেরামতিতে খরচ ধরেছে ৩৮ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। বাকি দু’কিলোমিটার রাস্তা মেরামতির দায়িত্ব নিয়ে পূর্ত দফতর খরচ ধরেছে কিন্তু ৩২ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা। তাতেই রাস্তা মেরামতির বরাদ্দ নিয়ে জেলাপরিষদ এবং পূর্ত দফতরের মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক ঢাকতে এখন সম্পূর্ণ আড়াই কিলোমিটার রাস্তা মেরামতির দাবি করে জেলাপরিষদ থেকে পূর্ত দফতরের কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ নিয়ে রাজ্য স্তরে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
এ দিন বিষয়টি নিয়ে মুখে খুলতে চাননি সভাধিপতি ললিতা টিগ্গা। রাস্তা নিয়ে কোনও বিতর্ক হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। পূর্ত দফতরের নির্বাহী বাস্তুকারকে অপমান ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সে প্রসঙ্গে সভাধিপতি বলেন, ‘‘আমি কিছু জানি না। তবে জেলাশাসককে সম্পূর্ণ রাস্তা মেরামতির দাবি জানিয়েছি।’’ কিন্তু জেলাপরিষদ সূত্রেই খবর, হিলির ওই আড়াই কিলোমিটার রাস্তা মেরামতির সিদ্ধান্তের (রেজুলেশন) বদলে সভাধিপতি মাত্র ওই ৬০০ মিটার রাস্তা মেরামতির সিদ্ধান্ত নিয়ে গত সপ্তাহ কাজের শিলান্যাস করেছিলেন। তা ছাড়া পূর্ত দফতর দু’কিলোমিটার রাস্তা মেরামতির কাজ শুরু করেছে। ফলে জেলাপরিষদের এখন আর সম্পূর্ণ রাস্তা মেরামতির উপায় নেই বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে।
জেলা পরিষদের সভাধিপতি, সহকারী সভাধিপতি সমেত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের অনুগামী। হিলি এলাকাটি মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীর বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। অথচ জেলাপরিষদের ওই রাস্তার সিংহভাগ মেরামতির কাজ মন্ত্রীর দফতর করলে বাকি ৬০০ মিটার রাস্তা মেরামতিতে যে ওই পরিমাণ টাকা খরচ হবে না, তা বুঝতে পেরে ওই শিলান্যাসের দিন হিলিতে বিপ্লবগোষ্ঠীর জেলাপরিষদ সদস্যের নামে মন্ত্রীগোষ্ঠীকে কটাক্ষ করে লিফলেট ছড়ায়। সেই অভিযোগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। কিন্তু তার আগে পূর্ত দফতরের তরফে ওই দু’কিলোমিটার রাস্তা মেরামতির ওয়ার্ক অর্ডার হয়ে যায়। দলের একাংশের অভিযোগ, মাত্র ৬০০ মিটার রাস্তা মেরামতিতে ৩৮ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা খরচ দেখানোটা সভাধিপতির রীতিমতো ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে। আবার সম্পূর্ণ রাস্তা মেরামতি করে ওই টাকা খরচ দেখানোর রাস্তাও বন্ধ। ফলে পূর্ত দফতর নিযুক্ত ঠিকাদার সংস্থার কাজে বাধা ও হুমকির পথে হেঁটে সভাধিপতিকে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বলে দলীয় স্তরে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টিতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও জড়িত বলে প্রশাসনের তরফে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সভাধিপতির বিরুদ্ধে জেলা পূর্ত দফতরের নির্বাহী বাস্তুকারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে বিভাগীয় প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ইন্দিবর পান্ডে দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলাশাসককে সোমবার সন্ধ্যায় ফোন করেন। সভাধিপতি সরকারি কাজে বাধা দিতে পারেন কি না তা জানতে চান তিনি। এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ পেয়ে জেলাশাসক তাপস চৌধুরী হিলিতে রাস্তার কাজে বাধাদানকারীর বিরুদ্ধে জেলা পূর্ত দফতরের আধিকারিককে এফআইআর দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দিন জেলাশাসক তাপস চৌধুরী বলেন, ‘‘হিলিতে ওই রাস্তা মেরামতির কাজে যেই বাধা দিন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পূর্ত দফতরের আধিকারিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ জেলা প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপে আপাতত পিছু হটলেও দলীয় স্তরে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে সভাধিপতি দাবি করেন, ‘‘জেলাপরিষদের রাস্তা। জেলা পরিষদেরই মেরামতির দায়িত্ব দেওয়া উচিত।’’ তবে কেন জেলাপরিষদের সভায় তা রেজুলেশন (সিদ্ধান্ত) করা হল না, তার সদুত্তর দেননি সভাধিপতি।
যদিও জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে হিলির ওই রাস্তাটি মেরামতির অভাবে বেহাল হয়ে বাসিন্দাদের চলাচলের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা মেরামতির জন্য জেলাপরিষদের তহবিলে টাকা না থাকায় গত বছর ডিসেম্বরে তপনের বাঘইট এলাকার সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিলির ওই রাস্তা সহ তপন ও বালুরঘাট এলাকায় জেলা পরিষদের ৫টি বেহাল রাস্তা মেরামতির জন্য আবেদন করেছিলেন বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা। ওই সভামঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি জেলা শাসককে দেখতে বলে যান।
এ দিন তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলাশাসকের আবেদনে পূর্ত দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি দফতরের নিজস্ব তহবিল থেকে রাস্তাগুলি মেরামতিতে আর্থিক বরাদ্দ মঞ্জুর করেন। সেই মতো হিলির ওই অংশটুকুর কাজ পূর্ত দফতর করছে। বাকিটা করছে জেলাপরিষদ। তাতে অসুবিধা কোথায়?’’ তা ছাড়া পূর্ত দফতরের সিডিউল অনুযায়ী ওই দু’কিলোমিটার রাস্তা মেরামতিতে প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে শঙ্করবাবু জানিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy