সালিশি সভা বসিয়ে নিদান দেওয়ার প্রবণতা মালদহে বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার এক যুবককে চোর সন্দেহে প্রথমে মারধর করা হয়। তারপরে সালিশি সভা বসিয়ে তার যৌনাঙ্গে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়ার নিদান দেওয়া হয়। এলাকার কয়েকজন বাসিন্দাই তারুল শেখ নামে ওই যুবককে উদ্ধার করে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। তারুল এখনও সেখানেই ভর্তি।
তারুলের ঘটনার মাত্র তিন দিন আগেই যদুপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের নাগরপাড়ায় এক মহিলাকে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দিয়ে তাঁরই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মাথার চুল কেটে দিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার অভিযুক্তেরা এখনও ফেরার। তবে তারুলকে নিগ্রহের অভিযোগে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার ধৃতকে পেশ করা হয়েছে মালদহ জেলা আদালতে। মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এমন ঘটনা কখনও কাম্য নয়। অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয়েছে। ইতিমধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।’’
জেলাতে সালিশি সভার ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন সিপিএমের বিধায়ক খগেন মুর্মু। তিনি বলেন, ‘‘জেলা জুড়ে ক্রমশ এমন ঘটনা বাড়ছে। জেলা পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। সালিশি সভার বিষয়টি আমি বিধানসভায় তুলে ধরব। জেলাশাসক শরদকুমার দ্বিবেদীও বলেন, ‘‘এমন ঘটনা কাম্য নয়। জেলাতে কেন এমন হচ্ছে তা আমি তদন্ত করে দেখছি। পুলিশের সঙ্গেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলা হবে।’’ রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী তছা ইংরেজবাজারের পুরপ্রধান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। পুলিশ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।’’
ইংরেজবাজারের যদুপুর ১ গ্রামপঞ্চায়েতেরই পুকুর পাড়ার বাসিন্দা তারুল। তিনি ওই এলাকার জহর মডেল কলোনির একটি ইমারতি দ্রব্যের দোকানে পাঁচ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন। তাঁর এক ছেলে জামি আকতার ও এক মেয়ে সামিমা খাতুন। জামি পঞ্চম শ্রেণিতে এবং সামিমা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। দোকানের মালিক হেফজুর রহমানের প্রায় ৮০ হাজার টাকা সম্প্রতি হারিয়ে যায়। এর জন্য সন্দেহ করে তারুলকে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তারুলকে নিয়ে দোকানে মোট ১০ জন কর্মী ছিলেন।
অভিযোগ তারুলকে চোর অপবাদ দিয়ে প্রথমে মারধর করা হয়। এরপরে দোকানের পাশে গ্রামে একটি সালিশি সভা বসানো হয়। সেই সালিশি সভায় নেতৃত্ব দেন গ্রামের মোড়ল আলাউদ্দিন মিঞা এবং সারোয়ার আলি। এই দুই মোড়ল এবং দোকানের মালিক তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত। দোকানেরই কর্মীদের নিয়ে চলে সালিশি সভা। অভিযোগ, সালিশিতে দোষ স্বীকার না করায় দু’টি গোটা ইট তারুলের পুরুষাঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়ার নিদান দেন মোড়লেরা। এমনকি তাঁর দুই হাতও বেঁধে দেওয়া হয়। প্রায় ৩০ মিনিট এই ভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তাঁকে। এরপরেই বিষয়টি এলাকাবাসীদের নজরে আসতে তাঁরা ছুটে গিয়ে তারুলকে উদ্ধার করে ভর্তি করেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। এখনও অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
এই ঘটনায় গ্রাম জুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। এদিনই রাতে ইংরেজবাজার থানায় আক্রান্ত ওই যুবকের স্ত্রী ছবি বিবি গ্রামের দুই মোড়ল সহ মোট আট জনের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এই ঘটনায় সামিম শেখ নামে এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪১, ৩২৫, ৩২৬ ও ৫০৬ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।
অভিযুক্তকে আদালতে পেশ করা হলে বিচারক এ দিন তাঁকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। তারুল বলেন, ‘‘আমি পাঁচ বছর ধরে ওই দোকানে কাজ করছি। কোনও দিন এমন কাজ করিনি। এদিন হঠাৎ করে আমাকে চোর অপবাদ দিয়ে মারধর শুরু করে দেন দোকানের মালিক, ম্যানেজার সহ অন্যরা। এরপরে গ্রামের মোড়ল গিয়ে বিচার বসিয়ে আমাকে এমন শাস্তি দেয়। কিছু ক্ষণ থাকার পরেই আমি উল্টে পড়ে যাই।’’ তাঁর স্ত্রী ছবিবিবি অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে যারা এমন ভাবে অত্যাচার করেছে, পুলিশ তাঁদের যেন কঠোর শাস্তি দেয়।’’
তবে সালিশির বিষয়টি জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ইমতিয়াজ হোসেন এবং গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য আনুয়ারা বিবি। তাঁরা জানান, রাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খবর পেয়েছেন। ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘এমন ভাবে শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি। ছেলেটি ভুল করলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা যেত।’’ ইমতিয়াজ ও আনুয়ারা জানান, আলাউদ্দিন ও সারোয়ার আলি তাঁদের দলের সক্রিয় কর্মী নন, তবে দলের সমর্থক। এদিন স্থানীয় বাসিন্দারা দোকানটি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এদিনের ঘটনার তিন দিন আগে গত শনিবার রিঙ্কিবিবি নামে এর মহিলাকে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দিয়ে মাথার চুল কেটে দেয় তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। এই ঘটনার অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেও এখনও অধরা অভিযুক্তরা। তাঁদেরও গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন ওই মহিলার পরিবার ও স্থানীয়েরা। জেলার পুলিশ সুপার জানান, অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy