Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বন্ধ দোকানে ছাই দুই শিশু

আমি তো জানি তখন ওরা পুড়ছে

সকাল থেকে গভীর রাত অবধি বাচ্চা দুটো হোটেলে খাটছে। দেখে একেক সময় মায়া হতো। কতই বা বয়স হবে ওদের। আমার ছেলে শুভমের বয়স ১১ বছর। ওরই বয়সী হবে হয়তো। বা দু-এক বছরের বড়।

দীপালি ভান

দীপালি ভান

দীপালি ভান (ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গৃহবধূ)
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

সকাল থেকে গভীর রাত অবধি বাচ্চা দুটো হোটেলে খাটছে। দেখে একেক সময় মায়া হতো। কতই বা বয়স হবে ওদের। আমার ছেলে শুভমের বয়স ১১ বছর। ওরই বয়সী হবে হয়তো। বা দু-এক বছরের বড়। ওদের সঙ্গে শুভমের বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। কী যেন নাম ওদের! হোটেল মালিক ডাকতো কালুয়া আর লালু বলে। আর বেশি কিছু তো জানি না। শুনেছি হোটেল মালিকের বাড়ি বিহারে। ছেলে দুটিও সম্ভবত সেখানকারই। দেশ থেকেই ওদের নিয়ে এসেছিল মালিক।

রোজ আমাদের বাড়ির সামনে বেড়াটার উপরে ওরা জামা-কাপড় শুকোতে দিত। আজও দেখছি, রাত থেকে মেলে দেওয়া জামা শুকোচ্ছে। কিন্তু ছেলে দুটোই তো আর নেই! দাউ দাউ আগুনে পুড়ে গেল, অথচ বাঁচাতে পারলাম না।

এখনও ভুলতে পারছি না। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠছে ওই বাড়িটা। দাউ দাউ করে জ্বলছে।

কাল গভীর রাতে দোকানে যখন আগুন লাগে তখন প্রথম টের পায় আমার স্বামী চন্দের। সঙ্গে সঙ্গে ও দমকলে ফোন করে। তার পরে নিজেই লোকজন ডেকে লম্বা পাইপ বের করে আগুন নেভানোর কাজে নেমে পড়ে।

তত ক্ষণে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, ধোঁয়া বের হতে হতে হঠাই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল ঘরদোর। যত বার সে দিকে তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে, বাচ্চা দুটো ওই ঘরে। ওরা তো পুড়ে যাচ্ছে! দরজা খুলে বের করা হবে কী ভাবে ওদের? কেউ কি চেষ্টা করছে? কিন্তু তখন যে ভাবে আগুন জ্বলছে, তাতে কে যাবে ওই ঘরের কাছে!

আমার ছেলে তখন আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বারবার জিজ্ঞাসা করছে, ‘মা ওরা কোথায়?’ উত্তর দিতে আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল। কোনও মতে ছেলে বললাম, ওরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমি তো জানি, ওরা তখন আসলে পুড়ছিল। হয়তো চিৎকারও করছিল। দরজা ধাক্কাও দিচ্ছিল। কিন্তু কেউ খুলে দিতে পারেনি। ওই ঘরে আটকে থেকে পুড়ে গেল ছেলে দুটো। এই কথাগুলো যত বার ঘুরে ফিরে আসছিল মনে, আমার সারা শরীর গুলিয়ে উঠছিল। এক সময় অসুস্থ বোধ করলাম। ঘাড়ে-মুখে জলের ছিটে দিতে বাঁচতে চাইছিলাম চিন্তাটা থেকে। কেন জানি, ওদের সঙ্গে বারবার আমার নিজের ছেলের তুলনাটা চলে আসছিল মনে।

অনেক আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। মৃণাল সেনের ‘খারিজ’। সেখানেও এমনই একটা বাচ্চা ছেলে বদ্ধ রান্নাঘরে রাতে শুয়ে মরে পড়েছিল। সেই বাড়িতেও ওই ছেলেটির বয়সী একটি ছেলে ছিল। ঠিক যেন আমার শুভমের মতো।

শুভমকে দেখলাম, বারবার বাথরুমে যাচ্ছে। ও কি কাঁদছিল? বুঝতে পারছিলাম না। এমনিতে মায়ের কোল ঘেঁষে থাকা ছেলে হঠাৎই যেন অন্যরকম হয়ে গেল। কিছুটা বড়ও হয়ে গেল যেন।

এ দিন সকালেও শুভম খোঁজ করছিল বাচ্চা দুটোর। কী বলব? আমি চুপ করে রয়েছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Burning Family
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE