‘রায় ভিলা’ আজও নিবেদিতার স্মৃতি বহন করে চলেছে। — নিজস্ব চিত্র
দার্জিলিংয়ের রাস্তায় একদিন নিবেদিতার সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দেখা হয়। নিবেদিতার হাতে ছিল একটি বড় লাল গোলাপ। তিনি হাসতে হাসতে সেই গোলাপটি দেশবন্ধুর কোটের বোতামে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘‘আমি আপনাকে মহৎ বলিয়াই জানিতাম, কিন্তু আপনি এত মহৎ জানিতাম না।’’
১৯০৯ সাল। অক্টোবরের মাঝামাঝি পূজাবকাশে চলে এলেন দার্জিলিং। সঙ্গী বসু পরিবার। পরের বছরও পুজোর ছুটি কাটাতে বেছে নিলেন দার্জিলিং পাহাড়কেই। এ যাত্রায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হল না। টেলিগ্রাম এল, মিসেস বুল গুরুতর অসুস্থ। খবর পাওয়া মাত্র দেরি করলেন না। দার্জিলিং থেকেই যাত্রা করলেন আমেরিকার উদ্দেশে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
১৯১১। নিবেদিতার ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় জগদীশচন্দ্র প্রস্তাব দিলেন দার্জিলিং যাত্রার। ঠিক হল, অবলা বসুর ভগ্নীপতি দ্বারকানাথ রায়ের ‘রায়ভিলা’ই হবে তাঁদের প্রবাসের বাসা। সম্মতি দিলেন নিবেদিতা। বসু দম্পতি বেরিয়ে পড়লেন আগেই। পৌঁছে প্রস্তুতি নিলেন সিকিম সফরে যাওয়ার। ১৭ বোসপাড়া লেন বাগবাজার থেকে ২১ সেপ্টেম্বর নিবেদিতা মিস্টার ও মিসেস এস কে রাটক্লিফ-কে লিখে জানালেন ‘‘উই উইল লিভ টুমরো ফর দার্জিলিং।’’ দার্জিলিংয়ে এসে জগদীশচন্দ্রর সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে নিবেদিতা মহা খুশি, ‘‘ওখানে একটি মঠ আছে, দেখব।’’ দার্জিলিং থেকে তিব্বতের পথ ধরে যেতে হবে সান্দাকফু। সেখানে ১২ হাজার ফুট উঁচুতে বৌদ্ধ মঠ, সেটাই দ্রষ্টব্য।
ঘোড়ায় জিন বাঁধা হল। বিছানাপত্র খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে যাত্রার আয়োজন যখন সম্পূর্ণ, হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা। জ্বর, সঙ্গে রক্ত-আমাশা। ডাক্তার নীলরতন সরকার তখন দার্জিলিংয়ে। খবর পাঠানো হল তাঁকে। চিকিৎসা শুরু করে বুঝলেন, নিরাময় সম্ভব নয়। সেবাযত্নের ভারটি নিলেন বসুজায়া। নিবেদিতার রোগশয্যার পাশেই সর্বক্ষণ বসে থাকতেন। প্রবোধ দিতেন—‘‘এ রোগ প্রাণঘাতী নয়। শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে।’’ কিন্তু নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন, শেষের দিন আসন্ন। আশ্বাস দিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না। বললেন, ‘‘লেট দেয়ার বি নো হাইডিং অ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু প্রোলং।’’ জগদীশচন্দ্র তখন বিষয়টিকে ভুলিয়ে রাখার জন্য, মনকে ভরিয়ে রাখার জন্য পড়ে শোনাতেন নিবেদিতারই কোনও প্রিয় গল্প। তাঁর মন আলোড়িত হবে ভেবে তখন কোনও কোনও রচনাংশ বাদ দিয়ে পড়তেন জগদীশচন্দ্র, কিন্তু রোগশয্যায় শুয়েও নিবেদিতা কিন্তু সচেতন। ঠিক ধরে ফেলতেন এবং ফলে জগদীশচন্দ্রকে আবার পুরোপুরি পড়তে হতো।
শরীর অসুস্থ, রোগাক্রান্ত—কিন্তু চেতনা প্রখর, জাগ্রত। ৭ অক্টোবর। নিবেদিতার কথা মতো উকিল ডেকে আনা হল। নারীশিক্ষা প্রসারের যে সংকল্প করেছিলেন, জীবনের শেষ লগ্নেও তা অটুট। তৈরি করলেন দানপত্র। সঞ্চিত সমস্ত অর্থ, এমনকী ভবিষ্যতে গ্রন্থস্বত্ব থেকে আয়ের অর্থও স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলনের জন্য বেলুড় মঠের ট্রাস্টিদের হাতে সমর্পণ করলেন। শেষ প্রহরে নিবেদিতারই অনূদিত বৌদ্ধ প্রার্থনাবাণী পাঠ করে শোনালেন অবলা। আর নিবেদিতার কণ্ঠে ক্ষীণস্বরে উপনিষদের সেই দিব্যবাণী—‘‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়...।’’ বললেন, ‘‘তরণী ডুবছে, আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব।’’ ক’দিন ধরেই চলছিল মেঘ-কুয়াশার খেলা। শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর। কোনও খাবার মুখে তুললেন না। ওষুধও নয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা সূর্যের প্রথম আলো স্পর্শ করেছে হিমশিখরের চূড়া। ঘরে এসে পড়েছে তারই সোনালি আভা। খুলে ফেললেন অক্সিজেনের নলটি। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ফেললেন এই শৈলশহরের বুকে। দার্জিলিং শহরে তাঁর প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁকে শেষ দেখা দেখতে রায়ভিলার সামনে ভিড় জমে যায়। শেষ যাত্রায় পা মেলান বসু দম্পতি, ডাক্তার নীলরতন সরকার, শশীভূষণ দত্ত, যোগেন্দ্রলাল বসু, শৈলেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিশিকান্ত সেন বাহাদুর, বশীশ্বর সেনগুপ্ত, রাজেন্দ্রলাল দে প্রমুখ বিশিষ্ট জনেরা।
১৫ অক্টোবর ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকা লিখল —‘‘দার্জিলিঙে এত বড় শোভাযাত্রা ইতিপূর্বে কেহ
দেখে নাই।’’
শৈলশহরে নিবেদিতার স্মৃতি- বিজড়িত একমাত্র স্মারক ‘রায়ভিলা’ ২০১৩-র ১৬ মে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হস্তান্তরিত করেন রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে। ১০ জুলাই থেকে মিশনের কাজ শুরু হয় বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। সংস্কার করে বাড়িটির দ্বারোদ্ঘাটন হয় ২০১৪-র ১২ জানুয়ারি। বর্তমানে এটি রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। শৈল শহরটির সঙ্গে নিবেদিতার যে সংযোগ স্থাপন হয়েছিল একদিন, তা-ই এতে আরও বেশি সুদৃঢ় হয়।
২৮ অক্টোবর তাঁর জন্ম সার্ধশতবর্ষ স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সব স্মৃতিময় দিনগুলিকে, খুলে দেয় সেই সময়ের খাতা।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy