Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Pirpal Village

বিভেদের দুনিয়ায় ঐক্যের উদ্‌যাপন, মাটিতে শায়িত পীর, সম্মান জানিয়ে খাটে শোয় না পীরপাল গ্রামও

পীরবাবা মাটিতে শায়িত। তাই গ্রামের মানুষ তাঁকে সম্মান জানিয়ে কেউ খাটে শোন না। জনশ্রুতি, রাতে পীর ঘোড়ায় চেপে গ্রাম ঘুরতে বেরোন। তাই কেউ খাটে শুলে তাঁর বিপদ হতে পারে।

Image of the Pirpal Village

পীরপাল গ্রামে পীরকে সম্মান জানিয়ে গ্রামবাসীরা মাটির ঢিবির উপর ঘুমোন। — নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
গঙ্গারামপুর শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৩
Share: Save:

দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর ব্লকের পীরপাল গ্রামের মানুষ চৌকি বা খাটে ঘুমান না। তাঁদের বাড়িতে মাটির উঁচু ঢিবি বানিয়ে তার উপরেই শুয়ে ঘুমান। পীরপাল গ্রামের মাঝখানে একটি পুরনো স্থাপত্য, যাকে পীরের দরগা বা মাজার বলে বিশ্বাস করেন গ্রামবাসীরা। গ্রামে চলতি সংস্কার, পীরবাবা মাটিতে শায়িত। তাই গ্রামের মানুষ তাঁকে সম্মান জানিয়ে কেউ খাটে শোন না। জনশ্রুতি, রাতে পীর ঘোড়ায় চেপে গ্রাম প্রদক্ষিণে বেরোন। কেউ খাটে শুয়ে ঘুমালে এবং পীর তা দেখে ফেললে বিপদ হতে পারে।

কথিত আছে, ১৭০৭ সালে পীরপালের মাটিতে ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির দেহ সমাধিস্থ করা হয়। পুরনো স্থাপত্যের সামনে সে কথা জানিয়ে একটি সরকারি বোর্ডও লাগানো আছে। বখতিয়ার খলজিই পরবর্তী কালে পীরবাবা রূপে আবির্ভূত হন বলে বিশ্বাস গ্রামবাসীদের। যে বখতিয়ার খলজিকে যুদ্ধবাজ খলনায়ক হিসাবে জানে বাঙালি, তিনিই পীরপাল গ্রামে পীরবাবা। যাঁকে সম্মান জানিয়ে আজও কেউ খাট, পালঙ্কে শোন না।

দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর, তপন, হরিরামপুর-সহ বিভিন্ন এলাকা নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনে ঠাসা। এর মধ্যে গঙ্গারামপুরের পীরপাল অন্যতম। জেলার ইতিহাসবিদ সুমিত ঘোষ জানান, মাত্র ১৭ অশ্বারোহী নিয়ে ১৭০৭ সালে বখতিয়ার খলজি পাল বংশের লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সংগ্রামপুর, দেবীকোট-সহ গৌড়বঙ্গের দখল নেন। লক্ষ্মণ সেন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান। তার পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত এবং কামরূপ অভিযানে যান। কিন্তু সেখানে বিফল হয়ে আবার দেবীকোটে ফিরে আসেন। ১২০৬ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে শয্যাশায়ী অবস্থায় বখতিয়ার খলজির মৃত্যু হয়। কথিত আছে, খলজির দেহ পীরপালেই সমাধিস্থ করা হয়। যদিও এ নিয়ে মতবিরোধ আছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে। অনেকেই দাবি করেন, এটি আসলে পীর বাহাউদ্দিনের সমাধি। তা থেকেই গ্রামের নামকরণ।

গ্রামবাসী মহাদেব রায় বলেন, ‘‘চৌকি বা খাটে ঘুমোলে স্বপ্নাদেশে ভয় দেখানো হয়। বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে আমরা গল্প শুনে আসছি যে, রাতে চৌকি বা খাটে শুলে স্বপ্নে ঘোড়া ছোটার আওয়াজ পাওয়া যায়। খাট থেকে ফেলে দেয়। আর শেষে ওই পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে।’’ তাই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই খাটের জায়গায় মাটির ঢিবি করে রাখা আছে। তার উপরেই চাদর বিছিয়ে বিছানা করে ঘুমোন মানুষ। ঘরে চেয়ার, টেবিল থাকলেও থাকে না খাট বা চৌকি। প্রতি বছর বৈশাখে দরগাকে কেন্দ্র করে পীরবাবার মেলা বসে। বহু দূর দূর থেকে মানুষ মেলা দেখতে আসেন। কিন্তু বর্তমানে দরগাটির করুণ দশা। সংস্কারের অভাবে তা কার্যত ধুঁকছে।

পীরপাল গ্রামের বধূ পিংকি দেব সিংহ বলেন, ‘‘আমরা বরাবরই মাটিতে শুই। কাঠের চৌকি বা খাটে গ্রামের কেউ ঘুমোন না। বখতিয়ার খলজিকে পীরবাবা মানার কারণে গ্রামের মানুষ প্রতি সন্ধ্যায় ধূপকাঠি দিতে যায় পীরের মাজারে। বৈশাখ মাসে আমরাই পীরের দরগার বাৎসরিক মেলার আয়োজন করি। যেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয়ে রীতি মেনে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। পীরের গান যেমন হয়, তেমনই হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠানও ঘটা করে পালন করি এই মাজারে।’’

বিজ্ঞানের যুগে এমন ঘটনাকে দুনিয়া কুসংস্কার বললেও পীরপালের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে বংশপরম্পরায় মেনে চলেছে এই প্রথা। ভেদাভেদ সর্বস্ব দুনিয়ায় পীরপাল যেন এক টুকরো ব্যতিক্রম। যেখানে ধর্মের নামে হানাহানি নেই। বরং, সেই ধর্মই এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে দুই সম্প্রদায়কে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE