ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ঘুরে বেড়ানো পশু-পাখিদের থেকে রোগ ছড়াচ্ছে এলাকায়। ছবি: সন্দীপ পাল।
শিলিগুড়ি শহরে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তাঁর বাড়ির সামনে এলাকার সব জঞ্জাল ফেলতে দেবেন? তা হলে শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকার কোনও গ্রামের বাসিন্দারা ওই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হবেন সেটা ভাবাও ঠিক নয়। শুধু তাই নয়, শহরের যাবতীয় জঞ্জাল গ্রামের কোনও এলাকায় ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হলে সেখানকার বাসিন্দারাও যে জোট বেঁধে কমিটি গড়ে পথে নামবেন, সেই ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত পুরসভা-প্রশাসন। তাই নেতা-কর্তারা সকলেই অন্তত ‘ডাম্পিং-গ্রাউন্ড’-এর ব্যাপারে অত্যন্ত মেপে পা ফেলেন। অতীতেও তেমনই দেখেছেন শহরবাসী। এখনও সেটাই হচ্ছে।
যেমন, সম্প্রতি পুরসভার তরফে একটি কমিটি গড়ার কথাও ঘোষণা হয়েছে। পুরসভার মেয়র তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ওই কমিটিতে বিরোধী দলের প্রতিনিধি, প্রশাসনের নানা দফতরের অফিসারদের রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। এমনকী, ইস্টার্ন বাইপাসের যে সব এলাকার বাসিন্দারা ‘ডাম্পিং-গ্রাউন্ড’ সরাতে আন্দোলন করছেন তাঁদের প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়েছে। কমিটির অন্যতম লক্ষ্য হল, জঞ্জাল ফেলার জন্য নতুন জায়গা চিহ্নিত করা। ওই কমিটিতে আন্দোলনকারীরা থাকবেন কি না তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। কারণ, নতুন জায়গা খুঁজে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তা না পেলে আন্দোলনকারীদের মধ্যেই অন্তর্কলহের আশঙ্কা করছেন বাসিন্দাদের একাংশ। ফলে, গোড়াতেই কমিটি কতটা কর্মক্ষম হবে তা নিয়ে নানা সংশয় তৈরি হয়েছে।
আরও সংশয় আছে। তা হল, খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব মনে করেন, একজন মেয়র এককভাবে প্রশাসনের নানা দফতরের অফিসারদের নিয়ে কমিটি গড়তে পারেন না। ওই কমিটিতে ভূমিসংস্কার দফতর সহ নানা বিভাগের অফিসার, লাগোয়া জলপাইগুড়ি জেলার অফিসারদেরও রাখা হবে বলে ঘোষণা হয়েছে। মন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘পুরসভার অফিসারদের নিয়ে মেয়র কমিটি গড়তে পারেন। কিন্তু, জেলা প্রশাসনের অফিসারদের নিয়ে কমিটি গড়ার এক্তিয়ার মেয়রের কি আছে? পাশের জেলার এসডিও পদমর্যাদার অফিসারকে মেয়র কী ভাবে কমিটিতে রাখতে পারেন? এটা তো জেলা প্রশাসন, রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে পড়ে?’’ সেই কারণেই কমিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় ক্রমশ তীব্র হচ্ছে সব মহলেই।
তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এখনই কমিটি কতটা কী করতে পারবে সেই প্রশ্ন তুলতে চান না। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি উনি কমিটি গড়েছেন। এক মাসের মধ্যে নাকি রিপোর্ট দেবে কমিটি। দেখি কী রিপোর্ট দেয়! ডাম্পিং-গ্রাউন্ড-এর সমস্যা সমাধান করতে হবে। তা নিয়ে আমরাও কাজ করছি। মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
মেয়র তথা অশোকবাবু কিন্তু দাবি করেছেন, মত বিরোধ দূরে সরিয়ে খোলা মনে সকলে মিলে জঞ্জাল ফেলা নিয়ে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান করতে হবে। সে জন্যই তিনি সকলকে কমিটিতে থাকার অনুরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন। মেয়র বলেন, ‘‘শিলিগুড়ির ডাম্পিং গ্রাউন্ডের সমস্যা বহু পুরানো। এর সমাধান এককভাবে কেউ করতে পারবেন না। বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে সব দলকে একমত হয়ে এগোতে হবে। তাই কমিটিতে সকলকে থাকার অনুরোধ করব। সকলে মিলে এরকমাসের মধ্যে একটা রূপরেখা তৈরির চেষ্টা করব। এটা নিয়ে রাজনীতি করলে সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।’’
ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, গোড়া থেকেই রাজনীতি চলছে বলে জঞ্জাল-সমস্যা মিটছে না। কারণ, দূষণের অভিযোগে বাইপাস থেকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড সরানোর দাবি দীর্ঘদিনের। চয়নপাড়া, বৈকুন্ঠপল্লি, খোলাচাঁদ ফাপড়ি এলাকার বাসিন্দারা ২০১০ সাল থেকে কমিটি তৈরি করে আন্দোলন করছেন। বছর দুয়েক আগে জঞ্জাল ফেলায় বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল এলাকায় অন্তত ৫০ জন বাসিন্দাকে আটক করেছিল পুলিশ। সে সময়ে পুরসভার তৎকালীন বিরোধী দল বামেদের অনেক নেতাই বাসিন্দাদের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন বলে তৃণমূল নেতাদের একাংশের দাবি। আজ সেই আন্দোলনই ব্যুমেরাং হয়ে বাম বোর্ডের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেই নেতাদের দাবি।
এ হেন চাপানউতরে ক্ষোভ বাড়ছে শহরবাসীদের অনেকেরই। তাঁরা চাইছেন, জঞ্জাল ফেলার নতুন জায়গা যতদিন না মিলছে, ততদিন ইস্টার্ন বাইপাসের ওই এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বছরের পর বছর ধরে ফেলা জঞ্জালের পাহাড় কী ভাবে নষ্ট করা যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হোক। হুটহাট আগুন না ধরিয়ে বিজ্ঞানসম্মত কোনও পদ্ধতিতে তা পোড়ানো যায় কি না সেটা খতিয়ে দেখা হোক। জঞ্জাল পুড়িয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির যে সব প্রকল্প দেশ-বিদেশে রয়েছে তা অনুসরণ করতে বাধা কোথায় সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। শিলিগুড়ি শহরের আশেপাশে কোথাও নীচু এলাকা ভরাট করার দরকার রয়েছে কি না সেই ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন বাসিন্দারা। সে ক্ষেত্রে জঞ্জালের পাহাড়ের উচ্চতা কিছুটা হলেও কমানোর উপায় মিলবে বলেও আশা করছেন তাঁরা।
উপায় অনেক আছে। পুরসভা-প্রশাসন চাইলে ধীরে ধীরে জঞ্জাল সমস্যার সমাধান হতেই পারে। নেতা-কর্তারা চাইলে তা করতেও পারেন বলে শহরবাসীরা অনেকে মনে করেন। কিন্তু, শহরের জঞ্জাল সমস্যার সমাধান নাকি ভোটের রাজনীতি, কোনটি বেশি অগ্রাধিকার পাবে সেটাই দেখার বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy