বিকাশ ভট্টাচার্যের ‘দুর্গা’ সিরিজের অন্যতম একটি তৈলচিত্র।
বাবা অসুস্থ। তাই ছেলেরই দায়িত্ব। অনভ্যস্ত পায়ের চাপে আস্তে আস্তে গড়াচ্ছিল রিকশা। চা বাগানের সবুজে জুড়িয়ে যাচ্ছিল আমার চোখ। সদ্য আলোয় স্নান করা সবুজ। বোধনের ভোরের সবুজ। মাতৃরূপে, শক্তিরূপে, মহামায়ারূপে দূরে কোথাও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে দেবীর। ততক্ষণে অনেকটাই আড়ালে সরে গিয়েছে ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান। হঠাৎই চোখ আটকে গেল দাউদাউ চিতার আগুনে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। মাটিতেও কয়েক জনের কুণ্ডলীতেও তখন ঘুরপাক খাচ্ছে স্বজন হারানোর কান্না।
পুব আকাশের লাল তখন অনেকটাই ফিকে। সূর্য উঠেছে।
কী সব এতাল বেতাল চিন্তার তারটা ছিড়ে গেল আমার সদ্য কৈশোর টপকানো রোগাসোগা সারথির গলার স্বরে। ‘‘এইখান দিয়া যাইতাছি দেখতে পাইলি না।’’ রিকশার ঠিক সামনে দিয়ে লাল-নীল-হলুদ-সবুজের একটা রামধনু ছুটে যেতে যেতে ধমক শুনে থমকে দাঁড়াল একটু। ঢাকের আওয়াজে সবে ঘুম ভেঙেছে। তাই মা দুগ্গার মুখ দেখতে সেই দৌড়টাই তো আসলে বোধনের সকাল। আর তাতেই তারা এসে পড়েছিল একেবারে আমার রিকশার সামনে। কোনওমতে অঘটন রুখে আমার সদ্য যুবক সারথি চেঁচিয়ে উঠেছে তাই। কচি কচি মুখগুলিতে দেখছিলাম কল্পারম্ভের আনন্দ। রিকশা থেমে যেতেই আচমকা চুপ হয়ে যাওয়া তাদের কলকল শুরু হয়ে গেল আবার। তাতে স্বস্তি দেখলাম সেই মুখটাতেও।
বাড়িতে মৃত্যু পথযাত্রী বাবা। দাদা বন্ধ বাগানের শ্রমিক। সামনে ভরা সংসারের ‘ব্ল্যাক হোল’। জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ায় দিদির বাড়িতে ফিরে আসার পথে প্রশ্ন করে করে সে সবই জানছিলাম। রিকশা থেকে নেমে তখন ভাড়া মেটাচ্ছি। হঠাৎই সে বলল, ‘‘কাল সকালে যাবেন কোথাও? আসতে পারি তবে। শুধু ভাসানের দিন আমাকে পাবেন না। ঠাকুর জলে পড়বে। ওই দিনটা আনন্দ করব।’’
বিদায়ের বিষাদে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা কোন মন্ত্রে আনন্দ হয়ে যায়, উত্তর হাতরাচ্ছিলাম। তবে কি এমন শেষই ওর কাছে কাঙ্ক্ষিত? এমন উজ্জ্বল আর বিষাদ মাখা সমাপ্তি?
সাবেকি বিসর্জনের টানে বরাবর দশমীর ভোরে ছুটে যাই বাগবাজারে। রীতি মেনে পুজো শেষে হয় দর্পণে বিসর্জন। মাকে বিদায় জানাতে বাঁশের ও পারে তখন বিষণ্ণ ভিড়। সেই মানুষের মেলায় চোখ আটকে গিয়েছিল এক জনের চোখে। জোড় হাত বুকের উপরে। সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর। কপালের টিপে যেন অস্তমিত সূর্য। লাল পাড় গরদে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। গর্জন তেলে প্রতিমার মুখের জ্যোতি যেমন। পুজো শেষের আরতি চলছে। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে নেমে আসছে জলধারা। শঙ্খ-ঘণ্টা-ঢাকের বোলেও যেন তাঁকে ঘিরে নৈঃশব্দ। ঢাকের আওয়াজ ছাপিয়ে তখন কানে আসছিল পুরোহিতের মন্দ্র কণ্ঠ, ‘‘আবার এসো মা।’’ বিসর্জনের লগ্নে সেই আবাহন যে অনিবার্য। মন থেকে মনে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই শব্দ ক’টি। জন্ম হচ্ছিল প্রতীক্ষার।
দশমীর বিকেলে বাবুঘাটে গঙ্গার জলে ভেসে যাওয়া রাঙতার মুকুটে ঠিকরে আসছিল আলো। খালি গায়ে ইতিউতি শুকোচ্ছে কাদা। জলে ডোবানো পায়ের অস্থিরতায় গঙ্গাও চঞ্চল। জল থেকে তুলে আনা কার্তিকের মুকুটে সেজে জলেই সে দেখছিল নিজের প্রতিচ্ছবি। আর ভেসে যাচ্ছিল আনন্দে। বন্ধুরা তখন ব্যস্ত সাগর সেঁচে তুলে আনা মণিমুক্তোর হিসেব নিকেশে।
বেশ উৎসব উৎসব হয়ে ওঠে তখন শহরটা। কত আলো, অচেনা শব্দ-গন্ধের আবহ, তখন থেকেই অপেক্ষা শুরু। কখন ডুলিতে চেপে দুগ্গা নেমে আসবে জলের কাছাকাছি। ওদের কাছাকাছি। প্রতিমা জলে পড়লেই ঝাঁপ। মুকুট, খড়্গ, ত্রিশূল, এ সব রণসাজ ফেলে রেখেই তো গৃহিনী উমার ঘরে ফেরা। আর তৎক্ষণাৎ সে সব তুলে নিয়ে কুমোরপাড়ায় দে ছুট। রোজগারের কতকটা পরিবারের। বাকিটায় দিনকতকের জন্য দিব্যি ‘রাজা রাজা’ ভাব।
রেললাইনের ধারের ঝুপড়ির আব্রু সরিয়ে মাঝে মধ্যে দেখে যাচ্ছে মা। আগের ভাসানে গঙ্গা থেকে ওঠেনি কোলের একটা। এ বার তাই সতর্ক চোখ। ততক্ষণে রাঙতার মুকুট মাথা থেকে নামিয়ে ফের জলে ঝাঁপাতে তৈরি ছেলে। আবার দুগ্গা এলো যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy