নাব্যতা হারিয়েছে শহরের গদাধর নদী। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
হঠাৎই সাইরেনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে শহরবাসী দেখেছিলেন, ঘরের ভিতর জল থইথই। জলের তোড়ে উপরে গিয়েছে বাতিস্তম্ভ, তার ছিঁড়ে কেটে গিয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। পাড়ায় পাড়ায় তখন অন্ধকারে ভেসে আসছে, প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকা হাহাকার। দেওয়াল ধসে কারও প্রিয়জন চাপা পড়ে গিয়েছে, কেউ বা জলের তোড়ে ভেসে কোনও দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে নিথর হয়ে গিয়েছে। বিজয়া দশমীর দিন থেকেই কখনও ভারী, কখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলতে থাকায় উদ্বেগ ছিল। তিস্তায় নাগাড়ে জল বাড়তে থাকায় ছিল আশঙ্কাও। ১৯৬৮ সালের লক্ষ্মী পুজোর আগের রাতে জলপাইগুড়ি শহরের গলি থেকে রাজপথের উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছিল তিস্তার বাঁধ ভাঙা জল। শহরের প্রবীণদের একাংশের মতে, অর্থনৈতিক ভাবে শহরের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও অক্টোবরের সে রাতে জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল।
সরকারি নথি অনুযায়ী, ১৭৮৭ সালেও জলপাইগুড়ি শহর এলাকায় বন্যার বিবরণ হয়েছে। তখনও অবশ্য শহরের প্রতিষ্ঠা হয়নি। শহর প্রতিষ্ঠার পরে ১৮৮১ সালে প্রথম বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। সে হিসেবে শহর গড়ে ওঠার আগে থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত ২০টি বড় আকারের বন্যার তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে ১৯৬৮ সালের বন্যাই ভয়াবহতম বলে জানা যায়। সরকারি হিসেবে বন্যায় ২১৬ জনের মৃত্যুর উল্লেখ্য রয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। হাজারেরও বেশি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। অন্তত সাড়ে তিন হাজার বাড়ি আংশিক অথবা পুরো ভেঙে গিয়েছিল। জল নেমে যাওয়ার পরেও, পলি জমেছিল অন্তত সাত দিন। আনাচে কানাচে আটকে মানুষ, গবাদি পশুর দেহ। সে সব দিনে পচা গন্ধে ভারীয় হয়েছে ভোরের বাতাস, শহরে রাত নেমেছে প্রিয়জন হারানোর হাহাকারে। সময়ের সঙ্গে সে ক্ষতে প্রলেপ লেগেছে, ভেঙে যাওয়ার পরে তৈরি হয়েছে নতুন সেতু, বাড়ি, রাস্তা। কিন্তু নিকাশী পরিকাঠামো নিয়ে শহরবাসীর ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে।
তিস্তা নদীর বেশ কয়েকটি জলাধার ভেঙে এবং অসংখ্য ধসের কারণে ১৯৬৮ সালে জলপাইগুড়ি শহরকে প্লাবিত করে। বিশেষজ্ঞরা বন্যা না বলে আষট্টি সালের ঘটনাকে হড়পা বান বলে চিহ্নিত করেছেন। যদিও, সে বছরের আগে এবং পরে শহরে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ১৫টি বন্যা শহরের অপরিকল্পিত নিকাশি পরিকাঠামোর জন্যই বলে অভিযোগ করা হয়। মাঝারি বৃষ্টিতেও শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করলা নদী জলবন্দি করে ফেলত বাসিন্দাদের। আটষট্টির বন্যা সেই ক্ষোভকেই উস্কে দেয়।
যে ক্ষোভের কারণে বন্যা পরিদর্শনে আসা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে, গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে বলেছিলেন শহরের এক বাসিন্দা। এখন যিনি খ্যাতনামা এক লেখক। বন্যা পরিদর্শনে শহরে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীও। তবে তার আগে মন্ত্রিসভার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে জলপাইগুড়ির পরিস্থিতি দেখতে পাঠিয়েছিলেন ইন্দিরা। তেমনিই এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল রায়কতপাড়ায়। সে গল্প শোনালেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ। তাঁর কথায়, “তখন আমরা কলেজ ছাত্র। বন্যা দেখতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসেছেন। গাড়িতে তিনি কয়েকটি জায়গায় যাবে। হঠাৎই আমাদের স্যার মন্ত্রীকে বললেন, গাড়িতে নয়, হেঁটে গিয়ে দেখুন আমরা কী অবস্থায় রয়েছি।” মন্ত্রী অবশ্য সে কথা শোনেননি, কিন্তু ক্ষোভের কথা পৌঁছে গিয়েছিল প্রশাসনে। আনন্দগোপালবাবু জানালেন প্রতিবাদী সেই স্যারের নাম দেবেশ রায়।
শহরের নিকাশী ব্যবস্থার বেহাল দশার জন্য বিশেষজ্ঞ সমীক্ষায় যে ক’টি কারণ উঠে এসেছে, তার অন্যতম হল করলা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া। শহরের বিভিন্ন নর্দমার জল পলি ভরা মজে যাওয়া করলায় পড়তে না পেরে ফিরতে পথে শহরে ঢুকে পড়ে। শহর গড়ে ওঠার সময়ে যে নর্দমাগুলি শহরে তৈরি হয়েছে, তা অপরিকল্পিত বলে অভিযোগ। তাই অনেকটা কড়াইয়ের মতো আকৃতির শহরের জমা জল, শহরেই আটকে থাকে। ধরধরা, গদাধর, পাঙ্গার মতো ছোট নদীর মাধ্যমেও করলায় পড়তে পারলে জলবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না বলে সমীক্ষায় দাবি। এরপরে নানা সময়ে শহরের জলবদ্ধতার সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন নামে ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করেছে। তার অধিকাংশই এখনও ফাইল-গর্ভেই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। তবে, কিছুটা আশার আলোও রয়েছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy