বাইপাস দিয়ে যেতে যেতে কালিকাপুরের কাছে সদ্য তৈরি হওয়া বইয়ের দোকানটা চোখে পড়েছিল চিংড়িঘাটার শুভ্রা ঘোষের। খানিকটা কৌতূহলী হয়েই গাড়ি থামিয়ে ভিতরে ঢুকেছিলেন। কিন্তু ঢুকেই তাঁর চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।
বৈদ্যুতিন দাঁড়িপাল্লার ওপর একটা ‘আনা কারেনিনা’, একটা ‘রেজারেকশন’ আর একটা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর পুরনো সোভিয়েত সংস্করণ। যন্ত্র বলছে, বই তিনটির ওজন এক কেজি ন’শো ষাট গ্রামের কিছু বেশি। এক তরুণী দাঁড়িপাল্লার ওপর নানা বই চাপিয়ে উৎসুক হয়ে দেখছেন। কিন্তু ওজন বারেবারেই দু’কেজি ছাপিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ লিও টলস্টয়ের ওই তিন উপন্যাসের সঙ্গে দাঁড়িপাল্লায় চড়ল একটা চটি ‘ব্যাটম্যান’ কমিকস। এ বার দু’কিলোর মধ্যেই কুলিয়ে গেল চারটে বই। হাসি ফুটল তরুণীর মুখে।
শুভ্রাদেবীর বিস্ময়াবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে বসা যুবক হেসে বলেছিলেন, ‘‘দিদি, আমরা ওজন দরেই বই বিক্রি করি। মাত্র দু’শো টাকা কিলো!’’
হ্যাঁ, কলকাতায় এখন কেজি দরেই বিকোচ্ছে পুরনো বই। দোকানের নাম ‘বুকটুক’। সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, ‘কলকাতায় প্রথম বার। ওজন দরে বই’। বড়দের উপন্যাস থেকে শুরু করে বাচ্চাদের কমিকস পর্যন্ত সব রকমের বই রয়েছে। ক্রেতা ইচ্ছেমতো বেছে নিতে পারেন। মুড়ি-মিছরি এক দর। দু’শো টাকা কিলো।
এ শহরে পুরনো খবরের কাগজ-খাতাপত্র ওজন দরেই বেচে থাকেন আম গৃহস্থ। কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় চড়িয়ে দিস্তে দিস্তে বই বিক্রির দোকান সম্ভবত এই প্রথম দেখছে কলকাতা। অথচ পুরনো বইয়ের সঙ্গে সেই কবে থেকে জড়িয়ে আছে তিলোত্তমার ফুটপাথ-রাস্তা। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে প্রায়ই দেখা যায়, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেউ কেউ নাগাড়ে উবু হয়ে পুরনো বই ঘাঁটছেন। কিংবা হঠাৎ একটা দুষ্প্রাপ্য বই খুঁজে পেয়ে লাফিয়ে উঠছেন ‘ইউরেকা’ বলে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক মলয় রক্ষিত বলছিলেন, ‘‘পুরনো বই কেনা একটা নেশা। কত বার একটা বই খুঁজতে গিয়ে অন্য একটা অসাধারণ বই খুঁজে পেয়েছি। অনেকটা লটারির মতো।’’ পুরনো বইয়ের এক বিরাট সংখ্যক ক্রেতা রয়েছেন কলেজ স্ট্রিট, ধর্মতলা, রবীন্দ্রসদন, গড়িয়াহাট, গোলপার্ক অঞ্চলে। প্রবল দরাদরি করে বই কেনাটা যাঁদের কাছে দৈনিক বা সাপ্তাহিক অভ্যেস। কিন্তু ওজনদরে বই কেনা? নাহ্! মনে করতে পারলেন না অনেকেই।
যদিও কলকাতার আগেই দেশের বেশ কয়েকটি শহরে শুরু হয়ে গিয়েছিল ওজনদরে বই বিক্রি। বিপণন বিশেষজ্ঞ রাম রে একই কথা বললেন। আর পাঁচটা পণ্যের মতো বইও অনেক জায়গাতেই ওজনদরে বিক্রি হয়— জানালেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বই পড়ে থেকে নষ্ট হয় বলে অনেক বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাই জলের দরে বিক্রি করে দেয়।’’
কলকাতার ওজনদরের বই-বিপণীর ঝাঁপ খোলার মূলে কি তেমনই কোনও ভাবনা? ‘বুকটুক’-এর কর্ণধার যে ব্যাখ্যাটা দিলেন, তার দু’টো দিক।
প্রথমত, তিনি মেনেই নিলেন, এটি তাঁদের অভিনব বিপণন কৌশল। বললেন, ‘‘বাজার ধরার জন্য সবাই নতুন কিছু করছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে আমাদেরও নতুন কিছু করতে হবে।’’ তাঁর মতে, একটা সময়ে বই ছিল বাঙালির মনের খাবার। এখন পাল্টেছে সময়, পাল্টেছে রুচি। টান পড়েছে বইয়ের বাজারে। নবীন প্রজন্মের একটা অংশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অনলাইনে বই পড়ায়। নতুন বইয়ের গন্ধ আর উত্তেজিত করে না তাদের। কিন্তু ওজনদরে বই বিক্রি হলে আগ্রহটা ফিরতেও পারে।
দ্বিতীয় দিকটা হল, দাম। ‘বুকটুক’-কর্ণধারের কথায়, ‘‘ইদানীং খুবই বেড়ে গিয়েছে নতুন বইয়ের দাম। অথচ শপিং মলে গিয়ে দেখেছি, সস্তায় পেলে মানুষ পচা জিনিসও কেনে। তাই ভাবলাম, সস্তায় বই বিক্রি করলে মানুষ কিনবেই।’’ সস্তায় পুষ্টি। আগ্রহী ক্রেতা জুটলে ব্যবসারও পুষ্টি— এই হল সমীকরণ।
কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থাকে। সত্যিকারের বইয়ের নেশা কি কখনও দামের পরোয়া করেছে? কথায় বলে, বাঙালি বই পড়ার জন্য চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। ১) কারও কাছ থেকে ঝোলাঝুলি, বলতে গেলে প্রায় ভিক্ষে করে কাঙ্ক্ষিত বইটি চেয়ে নিয়ে, ২) কিনে নিয়ে, ৩) বই ধার নিয়ে এবং ৪) এই তিনটি রাস্তাকেই সযত্নে এড়িয়ে সরাসরি পছন্দের বইটি ‘হস্তগত’ করে। সাদা বাংলায়— চুরি করে! শোনা যায়, এক বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ নাকি এই কারণেই পাঞ্জাবিতে বড় পকেট রাখতেন! বইচোরদের নিয়ে নানা গল্প ভাসে বইপাড়ার বাতাসে। এমনকী বিক্রেতারাও এঁদের প্রতি বরাবর সহানুভূতিশীল। কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘বই বাছার নামে ছেলেমেয়েরা এক-আধটা বই সরিয়ে ফেলে। কিছু বলি না। মায়া হয়। বই-ই তো নিচ্ছে!’’
‘বুকটুক’ যদিও বলছে, কারও বইয়ের প্রবল নেশা থাকলেও দামের ব্যাপারটা মোটেও ফেলনা নয়। কর্তৃপক্ষের মতে, অনেক বিক্রেতার মধ্যেই পুরনো দুর্লভ বই অতিরিক্ত দামে বিক্রি করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ওজনদরে বিক্রিতে সেই সমস্যা নেই। দরদামেরও সুযোগও অবশ্য নেই। এখানে মনে রাখতে হবে, পুরনো বই আর দরদাম আজন্মকালের সঙ্গী। এক জনকে বাদ দিয়ে অন্য জনকে কি মেনে নিচ্ছেন ক্রেতারা?
উত্তর খুঁজতে ফেরা যাক ‘বুকটুক’-এ। প্রতি সন্ধ্যায় কিন্তু বেশ ভিড় হচ্ছে সেখানে। অনেকেই গাড়ি থামিয়ে ঢুকে পড়ছেন। রাজারহাটের বাসিন্দা সাহানা সেন জানালেন, এখানে এসে বেশ কিছু দুর্লভ বই চোখে পড়েছে তাঁর, যেগুলি
এমনি কিনতে গেলে ভালই খরচ হতো। কেজি দরে অনেকটাই কম পড়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কমে পেলে দরাদরি করব কেন? কলকাতায় আরও এই ধরনের দোকান
খোলা উচিত।’’
উল্টো মতও আছে। কেউ কেউ বলছেন, বইয়ের মতো একটা জিনিস ওজন দরে না বিকোলেই ভাল। যেমন কবি শ্রীজাত। বললেন, ‘‘আমার মন খারাপ লাগছে। পুরনো বই তো কতই কিনেছি। এখনও কিনি। কিন্তু বই যদি মুগডাল কিংবা পাঁঠার মাংসের মতো ওজনদরে বিক্রি হয়, খুব কষ্ট হবে।’’
আবার বর্ষীয়ান সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘এতে ক্রেতা বা বিক্রেতা, দু’পক্ষের ক্ষতি না হলে তো অসুবিধে নেই। বেশি দামের জন্য ভাল বই কিনে ওঠা যায় না। এই পদ্ধতিতে যদি পাঠকরা উপকৃত হন তাতে আপত্তির কিছু দেখি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy