এক যুগ পরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিরই প্রাথমিক লক্ষণ যেন চোখে পড়ছে রাজ্য রাজনীতিতে!
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সে বার ক্ষমতায় এসেছে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শিল্পায়নের রথ এগোচ্ছে, বিরোধীরা কোণঠাসা। সেই সময়েই সিঙ্গুরে পুলিশের লাঠি এবং নন্দীগ্রামে এই রকমই এক জানুয়ারির সন্ধ্যায় গুলি চলার ঘটনা ফের সক্রিয় করে তুলেছিল বিরোধীদের। এ বারও বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট সাফল্যের পর থেকে বিরোধীরা প্রায় ভূমিশয্যায়। হঠাৎই রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে শাসক দলের দুই সাংসদের গ্রেফতারি এবং তার পরে ভাঙড়ে বোমা-গুলি-লাঠির ঘটনা ফের নতুন উদ্যমে আসরে নামিয়ে দিল বিরোধীদের।
তফাত বলতে, তখন মমতা ছিলেন বিরোধী নেত্রী। আর এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে তাঁরই ব্যবহৃত পুরনো যুক্তি হাতিয়ার করেছে বিরোধী সিপিএম ও কংগ্রেস। তফাতের চেয়েও মিলটা অবশ্য আরও বেশি এবং নজর করার মতো। রাজনীতিতে বিরোধী পরিসর যে সব সময় থাকে, কিছু দলের ব্যর্থতায় সেখানে সাময়িক শূন্যতা তৈরি হয় মাত্র— এই সারসত্য ফের স্পষ্ট করে দিচ্ছে ভাঙড়-কাণ্ড।
ভাঙড়ে গত নভেম্বর থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের আন্দোলন শুরু হলেও কংগ্রেস বা সিপিএম নেতারা সেখানে যাননি। সেই সুযোগে ছোট কিছু বামপন্থী দল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী
কিছু প়়ড়ুয়া সেখানে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, মাওবাদীরাও ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছিল ভাঙড়ে।
রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, এ সবই প্রথম সারির বিরোধী দলগুলির ‘নিষ্ক্রিয়তা’র কারণে। ভাঙড়ে দু’টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটতেই যে নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে বিরোধীরা। ঠিক যেমন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামেও প্রথমে প্রতিবাদ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ছোট ছোট নানা সংগঠন। বড় ঘটনা ঘটতেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা। এক যুগের ব্যবধানে দু’বারের ঘটনা বিরোধী পরিসরের অনিবার্যতার তত্ত্বই ফের প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে!
ভাঙড়ে প্রাণহানির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বুধবার বিধাননগরে বড়সড় সমাবেশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব। একই দিনে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কলকাতার দফতরের সামনে ভাল জমায়েত করে এআইসিসি-র প্রতিনিধি অখিলেশ সিংহের সামনেই অধীর চৌধুরী, আব্দুল মান্নানেরা তৃণমূল নেত্রীকে আক্রমণ করে মনে করিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস এখনও সাইনবোর্ড হয়ে যায়নি! দুই কর্মসূচিই অবশ্য পূর্ব নির্ধারিত।
কিন্তু ভাঙড়ের ঘটনার জেরে দুই বিরোধী দলের সমাবেশই বাড়তি উদ্যম পেয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সমাবেশে দাঁড়িয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেই দিয়েছেন, ‘‘চোখ রাঙিয়ে প্রতিবাদ বন্ধ করে দেওয়ার দিন শেষ! আগের বারের চেয়েও বেশি লোক নিয়ে আমরা এ বার নবান্নে যাব। মুখ্যমন্ত্রী তৈরি থাকুন!’’
প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে বিরোধী নেতারা এ দিন আলাদা করে হলেও ভাঙড়ে গিয়েছেন, নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের লোকজন পুলিশের পোশাক পরে গুলি চালিয়েছে। এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই।’’
সিপিএমের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সাংসদ মহম্মদ সেলিম, বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী। সিপিআইয়ের প্রবোধ পণ্ডা, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের পার্থ ঘোষ, পিডিএসের অনুরাধা পূততুণ্ড, এসইউসি-র তরুণ মণ্ডল ও তরুণ নস্করেরাও তাঁদের মতো করে প্রতিবাদ করেছেন। আর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা থেকে সিপিএম তাদের ‘শহিদ তহবিলে’র জন্য যে টাকা তুলেছে, তা থেকে এক লক্ষ টাকা করে ভাঙড়ের দুই নিহতের পরিবারকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু। তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভাঙড়েই প্রতিবাদ শেষ নয়। ভাঙড়কে ছ়়ড়িয়ে দিতে হবে।’’
ভিড়ে ঠাসা সমাবেশে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্যবাবুরা সারদা ও রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে ‘পালের গোদা’কে জেরার দাবি তুলেছেন। আর গৌতমবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘‘সিবিআই দফতরে আমাদের প্রতিনিধিদল জানতে গিয়েছে, ভাইপোকে কবে ডাকবেন? পিসিকেও তো ডাকতে হবে! আমি অনেক দিন ধরে বলছি। পারলে (মমতা) আমায় জেলে ঢোকান!’’
নোট বাতিলের বিরুদ্ধে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে কংগ্রেসের জমায়েতও তৃণমূলের তিন দিনের ধর্না ঘিরে উৎসাহকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এআইসিসি পর্যবেক্ষক অখিলেশ সিংহের সামনেই রাজ্যে শাসক দলের তুলোধনা করেন অধীর চৌধুরীরা। কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে বহু মানুষের ভিড় দেখে প্রদেশ সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘তৃণমূলের ভূমিকায় মানুষ ক্ষুব্ধ। প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা জমায়েতে এসেছেন।’’
বিরোধীদের হুঙ্কার শুনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘ভাঙড়-কাণ্ড নিয়ে ওঁরা নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছেন। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। এত কথা বলতে হলে রাস্তায় নেমে দেখতে পারতেন! মমতা রাজ্যকে উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সেই সময়ে ওঁরা বিজেপি-র কায়দায় উস্কানি দিচ্ছেন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy