ধৃত শেখ বাদল
দু’হপ্তার ফারাক। সন্দেহভাজন পাক চরদের দু’-দু’টো আলাদা চক্র বা মডিউল ধরা পড়ল খাস কলকাতার বুকে। যাদের মধ্যে সরাসরি কোনও যোগ এখনও খুঁজে না-পেলেও অন্তত একটা জায়গায় সাংঘাতিক মিল দেখতে পাচ্ছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা।
তা হল জাল পরিচয়পত্র তৈরির কারসাজি। ওই সূত্রেই তিলজলার আখতার খান ও গার্ডেনরিচের ইরশাদ আনসারির ‘মডিউল’ বেমালুম মিলে গিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। লালবাজারের খবর’ গোপনীয়তা রক্ষার খাতিরেই গুপ্তচরদের বিভিন্ন মডিউলের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগ থাকে না। কলকাতাতেও তাদের কাজের ক্ষেত্র থেকে বসবাসের জায়গা— সব ছিল আলাদা। কিন্তু পাসপোর্ট বা ভুয়ো ভোটার কার্ড তৈরির তাগিদে তাদের একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলতেই হয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ।
বস্তুত সেই ‘যোগসূত্রের’ই সুবাদে বুধবার জালে পড়েছে আর এক চক্রী— শেখ বাদল। মাঝবয়সী লোকটি কলকাতার পাসপোর্ট অফিসে দালালের কাজ করে। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) এ দিন ব্রেবোর্ন রোডে পাসপোর্ট অফিসের কাছেই তাকে পাকড়াও করেছে। তার বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ?
লালবাজারের বক্তব্য, বাদল জাল পরিচয়পত্র তৈরির চক্রের অন্যতম চাঁই। পাক চর সন্দেহে মেরঠে ধরা পড়া মহম্মদ ইজাজকে জেরা করে গার্ডেনরিচের ইরশাদ আনসারির হদিস মিলেছে। ইরশাদের ছেলে আসফাক ও শ্যালক মহম্মদ জাহাঙ্গিরকেও ধরা হয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, জাহাঙ্গির এই বাদলকে দিয়েই ইজাজের জন্য ভুয়ো ভোটার কার্ড তৈরি করিয়েছিল। পাশাপাশি বাদলের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। এসটিএফের এক কর্তার কথায়, ‘‘তিলজলার আখতারও ভুয়ো নথি দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়েছিল ২০১৩-য়। আমরা দেখছি, সেখানেও বাদলের ভূমিকা ছিল কি না।’’
শেখ বাদলের পশ্চাৎপট কী?
এসটিএফের খবর, ইরশাদের যেমন বাংলাদেশ-যোগ রয়েছে, তেমন বাদলেরও পরিবার আছে বাংলাদেশে। বছর কুড়ি আগে সে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতে। একটি ছেলেও ছিল। জেরায় বাদল জানিয়েছে, বছর কয়েক আগে তার কিশোর ছেলেটি বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক গোলমালে মারা যায়। পরে বাদল ভারতে ফিরে এলেও বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এক সময় সে দর্জির কাজ করত। বছর ছয়েক হল, পাসপোর্ট অফিসে দালালি করছে। সেই সূত্রে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে তার আলাপ। এ দিন এসটিএফের এক কর্তা বলেন, ‘‘পাকিস্তানেও ওর যোগাযোগ থাকতে পারে। সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
এবং পরিচয়পত্র জালিয়াতির প্রসঙ্গেই আখতারের কথা টেনে এনেছেন এসটিএফের অফিসারেরা। কী রকম? গোয়েন্দারা বলছেন, দীর্ঘ দিন পাকিস্তানে কাটিয়ে আখতার ২০১১-য় কলকাতা ফেরে। পুরনো পাসপোর্ট হারিয়ে গিয়েছে— এই যুক্তিতে ২০১৩-য় নতুন পাসপোর্টের আবেদন করে, সঙ্গে জমা দেয় পুরনো পাসপোর্টের প্রতিলিপি। এর ভিত্তিতে নতুন একটি পাসপোর্ট পেয়েছিল আখতার। এখন গোয়েন্দারা জেনেছেন, ওই প্রতিলিপিটি ছিল ভুয়ো। তাতে যে পাসপোর্ট নম্বরের উল্লেখ রয়েছে, সেটি অন্য এক ব্যক্তির। তা আখতার এমন জালিয়াতি করতে গেল কেন?
গোয়েন্দা-সূত্রের ব্যাখ্যা: আখতারের ভাই জাফর ১৯৮৯-এ পাসপোর্টের আবেদন করেছিল, যা বিশেষ কারণে মঞ্জুর হয়নি। ১৯৯০-এ সালে জাফর চোরাপথে পাকিস্তানে চলে যায়, ২০০৯-এ ফিরে আসে। আগের আবেদনের তথ্য লুকিয়ে ২০১২-য় জাফর ফের নতুন পাসপোর্টের আর্জি জানালে তা-ও নামঞ্জুর হয়। ‘‘ভাইয়ের অবস্থা দেখেই আখতার ঝুঁকি নিতে চায়নি। সরাসরি জালিয়াতির পথ ধরে।’’— পর্যবেক্ষণ এক গোয়েন্দা-কর্তার। কিন্তু পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়পত্র জাল করা হচ্ছে কী ভাবে?
জানতে চেয়ে এ দিন কলকাতার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসার গীতিকা শ্রীবাস্তবকে ফোন করা হয়েছিল। উনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও উত্তর দেননি। তবে পাসপোর্ট অফিসের এক সূত্রের দাবি, আবেদনকারী সম্পর্কে পুলিশি রিপোর্টের ভিত্তিতেই পাসপোর্ট দেওয়া হয়। রিপোর্ট ঠিকঠাক থাকলে অফিসের করার কিছু থাকে না। এ দিকে মেরঠে ধৃত ইজাজকেও লাগাতার জেরা করে চলেছেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের অফিসারেরা। তাঁদের দাবি, সামরিক তথ্য হাতানোর লক্ষ্যে ইজাজ কয়েক জন ফৌজি অফিসারের সঙ্গে দোস্তি করেছিল। তাদের আইপ্যাডের মতো দামি দামি ‘ভেট’ও দিয়েছিল। দেখা হচ্ছে, গার্ডেনরিচে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জাহাজ কারখানাতেও এমন কোনও অফিসারের সঙ্গে পাক চরদের মাখামাখি ছিল কি না।
এনআইএ ইতিমধ্যে লালবাজারে এসে ইরশাদদের জেরা করে গিয়েছে। কলকাতার এসটিএফ-ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ‘‘দরকারে আমাদের টিম উত্তরপ্রদেশে গিয়ে ইজাজকে জেরা করবে।’’— বলেছেন লালবাজারের এক কর্তা।
বুধবারই রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরের তিন নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকা থেকে আইএসআই চর সন্দেহে আরও এক জনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে এসটিএফ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy