পৈলানে তৃণমূলের কর্মিসভায় মুকুল রায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বুধবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
ভরা সভায় এক রহস্য ফাঁস করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
অন্য রহস্যে জুড়লেন নতুন মাত্রা।
বুধবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার পৈলানে তৃণমূলের কর্মিসভায় মমতা বললেন, “দলের ব্যাপারে, প্রশাসনিক ব্যাপারে কথা বলতে হয়। আমি দিনে পাঁচশো বার মুকুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। সুব্রত বক্সীদা, কাননের (মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গেও কথা বলি।” এই মন্তব্যে দল এবং সরকার চালাতে সতীর্থদের সঙ্গে কী পরিমাণে ফোনালাপ করতে হয় তৃণমূল নেত্রীকে, সেই রহস্য ফাঁস হল। কিন্তু দলে মুকুল রায়ের অবস্থান এখন ঠিক কোথায়, আরও ঘনীভূত হল সেই রহস্য।
মমতা পরিষ্কার করে বলেননি। কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন, খবর রাখতে এবং খবর দিতে ফোনই তাঁর মোক্ষম হাতিয়ার। আর তৃণমূল সূত্র বলছে, নেত্রীর গাড়ির পিছনের সিটে কার জায়গা হচ্ছে, সেটা যেমন তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একটা ইঙ্গিত, তেমনই কে ক’টা ফোন পাচ্ছেন, সেটাও আর একটা ইঙ্গিত। সারদা-তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পরে ইদানীং মুকুলের সঙ্গে মমতার দূরত্ব বাড়ছিল বলেই মনে করছিলেন অনেক তৃণমূল নেতা। মমতার এ দিনের মন্তব্য তাঁদের বিস্ময় বাড়িয়েছে।
তবে মমতার ফোন-সূত্রে শুধু যে মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী বা শোভন বাঁধা পড়েন, এমন নয়। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, দিনে অন্তত ২০টা ফোন আসে দলনেত্রীর কাছ থেকে। বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, “কত বার ফোন করে গুনে রাখিনি। তবে দিনে রাতে মমতা ফোন তো করেই, মেসেজও করে। অনেক রাতেও ফোন করে বলে ফোন খুলে রাখতে হয়!” একই সুর রাজ্য সভাপতি বক্সীরও। “কত বার ফোন করেন, তার সংখ্যা তো মনে রাখিনি! যখনই দরকার হয়, নেত্রী আমাকে ফোন করেন।” বলছেন তিনি।
কথোপকথনের বিষয়বস্তু কখনও রাজনৈতিক, কখনও প্রশাসনিক। কখনও হয়তো এ সবের বাইরে নেহাতই সাদামাঠা, ব্যক্তিগত। কিন্তু দিবারাত্র ফোন চলছেই! দলের ঘনিষ্ঠ সতীর্থেরা ছাড়াও সরকারের প্রধান হিসাবে এক গুচ্ছ আমলার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় মমতাকে। অতএব তাঁদের নম্বরেও ফোন বা মেসেজ যায় হরদম।
তার মানে, এক একটা ফোনের মেয়াদ যদি এক-দেড় মিনিটও হয়, তা হলেও অষ্ট প্রহরের গোটাছয়েক প্রহর জুড়ে মমতা প্রতীকী অর্থে ‘মোবাইল’!
মুকুলকে দিনে পাঁচশো ফোন হয়তো নেহাতই কথার কথা। তা সত্ত্বেও বাস্তব হল, মোবাইল নেটওয়ার্কে ভরসা করেই দু’হাতে দল এবং প্রশাসন চালাচ্ছেন মমতা। এবং ফোনের এই বহর শুনে ঘাবড়েই যাচ্ছেন মমতার বিরোধীরা!
বলাই বাহুল্য, মমতার মতো ফোন-চক্র তাঁর প্রতিপক্ষ কোনও দলেই নেই। তাই বিস্ময়ের মাত্রাও অপার! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী যেমন বলছেন, “এ তো দেখছি ফোনে ঢালিয়া দিনু মন!” দল চালাতে তিনি কত বার বিমান বসু বা নিরুপম সেনের সঙ্গে কথা বলেন? শ্যামলবাবুর জবাব, “বিমানদা দলের রাজ্য সম্পাদক। তিন মাসে হয়তো তিন-চার বার ফোনে কথা হয়। নিরুপমের সঙ্গে অতটাও হয় না।” কারণ, কলকাতায় থাকলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা প্রতি দিনই আলিমুদ্দিনে একে অপরের মুখোমুখি হন। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা কে কবে কোথায় আছেন, তার ডায়েরি থাকে। শ্যামলবাবুর কথায়, “পার্টি সেন্টারে কাজ করি। সামনাসামনিই তো অনেক কথা হয়ে যায়। কলকাতার বাইরে থাকলে তখনই মূলত ফোনে যোগাযোগের দরকার পড়ে।”
কংগ্রেসে এমন ফি রোজ বিধান ভবনে মিলিত হওয়ার চল নেই। কিন্তু সেখানেও এত ফোন চলে না! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কত বার ফোনে ধরেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপাকে? অধীরের কথায়, “খুব কম! আমার কিছু বলার থাকলে মেসেজ করে দিই!” সেই সঙ্গেই অধীর জুড়ছেন, “আমরা তো দিদির মতো নই! দিদির কাজ কম, কথা বেশি!”
কংগ্রেস বা সিপিএমের বিপরীত মেরুতে থাকলেও বিজেপি-র মোবাইল নেটওয়ার্কও মমতার মতো শক্তিশালী নয়! দলের প্রয়োজনে তথাগত রায় বা শমীক ভট্টাচার্যদের কত বার ফোন করেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ? “নির্ভর করে পরিস্থিতির উপরে। কখনও ৪-৫ বার, কখনও কম বা বেশি।” এই বলে রাহুলবাবুও প্রশ্ন তুলছেন, “এত যদি ফোনই করব, তো কাজ করব কখন? আর ওঁর ও’সব কথা তো মুকুলকে তোষামোদ করার জন্য!”
হতেই পারে, কাউকে বার্তা দেওয়ার জন্যই ফোন-বার্তার কথা এ দিন তুলেছেন মমতা। কিন্তু এটাও ঘটনা, ফোনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জলের সঙ্গে মাছের মতো! মোবাইলে লম্বা লম্বা কথোপকথনে তিনি যেমন চোস্ত, তেমনই দ্রুত টেক্সট মেসেজিংয়েও। মনে রাখতে হবে, খুব বেশি লোককে অকাতরে নিজের নম্বর বিলোন না তৃণমূল নেত্রী। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের এবং পছন্দের লোকেরাই তাঁর মোবাইল নম্বর পেয়ে থাকেন। তার মানে কেউ চাইলেই মমতাকে ফোনে ধরতে পারবেন না। মমতা যাঁকে নম্বর দেবেন, শুধু তাঁরাই যোগাযোগ করতে পারবেন তাঁর সঙ্গে। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “দলনেত্রীর নম্বর যদি বেশি লোক জানত, তা হলে না জানি কত লম্বা কল লিস্ট হতো!”
তৃণমূলেরই এক তরুণ নেতা সহাস্যে বলছেন, “মুকুলদা খুব পরিশ্রম করেন, সবাই জানে। এখন দেখছি, দিদির ফোন ধরতেই দাদার অনেক পরিশ্রম হয়!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy