প্রহৃত কর্মী অমিত ধর। —নিজস্ব চিত্র
মন্ত্রী মনে করছেন ‘ঈর্ষা’। আর তথ্য বলছে— লোকবলের অভাব।
গত ৭২ ঘণ্টায় রামপুরহাট হাসপাতালে রোগীর পরিজনদের হাতে চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের বারবার নিগ্রহের ঘটনার নেপথ্যে উঠে আসছে এমনই সব ব্যাখ্যা। যদিও রোগীর পরিজনদের আচরণে এখনও পর্যন্ত কোনও পরিবর্তন আসার লক্ষণ নেই। বৃহস্পতিবারও ওই হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাস্টার এবং এক নিরাপত্তারক্ষীকে মারধরের অভিযোগ উঠল রোগীর পরিজনদের বিরুদ্ধে। আগামী দিনে মেডিক্যাল কলেজের তকমা পেতে চলা ওই হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে পরপর এই ক্ষোভের ঘটনায় রাজ্যের গ্রাম-মফস্সল এলাকার বেহাল স্বাস্থ্য-পরিষেবার চেহারাটাই বেরিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন অনেক স্বাস্থ্য-কর্তা।
হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করছেন, ‘‘পরিষ্কার করে বলছি, এই হাসপাতালের পরিষেবার মান বেড়েছে। সেই কারণে উত্তরোত্তর হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেটাই এক শ্রেণির মানুষের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে চিকিৎসক নিগ্রহ থেকে অন্যান্য অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে।” আবার এসডিপিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাসের দাবি, হাসপাতালে প্রতিনিয়ত হিংসামূলক কার্যকলাপের পিছনে কোনও কিছুর ইন্ধন আছে। যদিও হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে কর্মী— কেউ-ই অবশ্য তা মনে করছেন না। ঘটনা হল, এ দিন অমিত ধর নামে যে ওয়ার্ড মাস্টারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে, তিনি আদতে এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। হাসপাতাল সুপার সুবোধকুমার মণ্ডল নিজে বলছেন, ‘‘এখানে নিত্য নতুন পরিষেবা চালু করা হয়েছে। তার পরিকাঠামো যথেষ্ট উন্নত। তবে, আমরা প্রয়োজনীয় লোকের অভাবে ধুঁকছি। ‘অন কল’ ডিউটিতে পাঁচ জন চিকিৎসককে ২৪ ঘণ্টা রাখার মতো পরিস্থিতি হাসপাতালে নেই। উপযুক্ত কর্মীর অভাবে ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে ওয়ার্ড মাস্টারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’
কী ঘটেছে এ দিন?
দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভোর ৫টা নাগাদ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে তিন জন ভর্তি হন। প্রাথমিক ভাবে দেখার পরে চিকিৎসক জখমদের পাশের রুমে ড্রেসিং করতে পাঠান। সেখানে দু’জন অস্থায়ী কর্মী ডিউটি করছিলেন। জখমদের এক এক করে ড্রেসিং করার জন্য টেবিলে ডাকা হয়। সেই সময় কেন চিকিৎসক এবং পর্যাপ্ত কর্মী নেই, সেই প্রশ্ন তুলে জরুরি বিভাগ মাথায় তোলেন রোগীর পরিজনেরা। এমনকী, একসঙ্গে তিন জখম ব্যক্তির ড্রেসিং করার দাবিও তোলেন তাঁরা। অমিতবাবুর দাবি, ‘‘ঝামেলা শুরুর আগেই আমি সার্জেনকে কল দিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ও সব কিছু না বুঝেই আমার জামার কলার ধরে টানা হেঁচড়া শুরু করেন। সেই সঙ্গে চড়-থাপ্পর, বুকে কিল ঘুষিও মারতে থাকে।’’
এ দিকে, ঘটনার প্রতিবাদে সকাল ১১টা নাগাদ সুপারের কাছে হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ ক্ষোভ জানান। তাঁরা জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানান। এমনকী, অপরাধীরা ধরা না পড়লে, তাঁরা কেউ কাজ করবেন না বলেও হুমকি দেন। পাশাপাশি তাঁরা ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে ‘অন কল’ ডিউটিতে চিকিৎসকদের থাকার এবং পুলিশ ক্যাম্প করার দাবিও জানান। ঘটনার পরপরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। সুপার সমস্যা মেটাতে এ দিনই এসডিও-র সঙ্গে বৈঠকে বসার আশ্বাসও দেন। আশিসবাবুর দাবি, ঘটনায় পুলিশ এক জনকে গ্রেফতারও করেছে। দুর্ঘটনায় আহতদের আত্মীয়দের যদিও দাবি, মারধরের ঘটনায় তাঁদের পরিবারের কেউ যুক্ত নন।
কেন এই হাসপাতালেই বারবার অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন রোগীর পরিজনেরা?
কারণ খুঁজতে গিয়ে পরিকাঠামোকেই দুষছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এখানে চিকিৎসক, নার্স, কর্মী ও টেকনিশিয়ানের যথেষ্ট অভাব আছে জেনেও অনেক কিছু পরিষেবা চালু করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোক দেওয়া হয়নি।’’ অথচ উত্তরোত্তর এই হাসপাতালে যে রোগীদের চাপ বাড়ছে, তা মেনে নিয়েছেন খোদ আশিসবাবুই। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এপ্রিল মাসে হাসপাতালের ইন্ডোর ও আউটডোরে রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫,৮১২ ও ১০, ৪৮৭। তিন মাস পরে অগস্টে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৯৫৩ ও ১৪,৭০৪-এ। হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসকের খেদ, ‘‘ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যদি কুকুরে কামড়ানোর রোগীকেও রেফার করে দেওয়া হয়, তা হলে রোগীর সংখ্যা তো বাড়বেই! কিন্তু তার ফলে এত কম লোক নিয়ে আমাদের উপরে কী পরিমাণ চাপ পড়ছে একবার ভাবুন।’’ চাপের কথা মানছেন আইএমএ-এর রামপুরহাট শাখার সম্পাদক তথা হাসপাতালের শল্য বিভাগের চিকিৎসক দেবব্রত দাসও।
লোক যে কম আছে, হাসপাতালের পরিসংখ্যান দেখেই তা স্পষ্ট হচ্ছে। এত রোগীর জন্য চতুর্থ শ্রেণির আছেন মাত্র ৩৪ জন। অথচ দরকার আরও ৬৫ জন। আবার নার্সের সংখ্যা ৮৫। সেখানে আরও ৯৮ জনকে দরকার। ওয়ার্ড মাস্টারের চারটি পদই খালি পড়ে। হাসপাতালে মোট টেকনিশিয়ান মাত্র ৭ জন। অথচ দরকার আরও পাঁচ জন। পাঁচ জন প্রয়োজন হলেও ‘ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট’-ই চলছে মাত্র এক জন টেকনিশিয়ানের ভরসায়। চিকিৎসকদের পনেরোটি শূন্যপদ পূরণে কাউকে পাঠায়নি স্বাস্থয দফতর। অথচ হাসপাতালের উন্নয়নে যে কোনও কিছুই করা হয়নি, এমনটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। ডায়ালিসিস ইউনিট, সিটি স্ক্যান, ডিজিটাল এক্স-রে, ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট চালু হয়েছে। প্যাথোলজি বিভাগ, ব্লাড ব্যাঙ্ক নতুন করে সাজানো হচ্ছে। তার পরেও লোকবলের অভাবই পরিষেবা নিয়ে রোগীর পরিজনদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি করছেন বলে মানছেন হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই।
এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তাঁর দাবি, গত দু’দিনের ঘটনার কথা তাঁকে কেউ জানাননি।
নিগৃহীত দুই চিকিৎসক হীরককান্তি দাস এবং আশিস সাহা, দু’জনেই বলছেন, ‘‘এই প্রতিকূল অবস্থার পরেও আমরা দিনরাত এক করে পরিষেবা দেওয়ার কাজ করে আসছি। তার পরেও অপমানিত হতে হল। এই পরিবেশে কি আর কাজ করা যায়?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy