প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে), পায়েল কর (ডান দিকে), পিছনে রামমন্দির। — ফাইল ছবি।
রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে তাতে লাগল নজরুলগীতির মূর্ছনা। সোমবার অনুষ্ঠানের ঠিক দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের সমাজমাধ্যমের পাতায় ‘শেয়ার’ করলেন কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান। ঘটনাচক্রে, যে গানটি গেয়েছেন বাংলার শিল্পী পায়েল কর। পায়েলের গাওয়া নজরুলসঙ্গীতটি শেয়ার করে প্রধানমন্ত্রী নিজের এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘‘প্রভু শ্রীরামের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা।’’ মোদী পায়েলের কণ্ঠে গীত নজরুলের লেখা এবং সুরারোপিত ‘মন জপ নাম’ গানটি পোস্ট করেছেন।
দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা পায়েল অবশ্য জানতেনও না যে, তাঁর গাওয়া গানটিই প্রধানমন্ত্রী পোস্ট করেছেন। শনিবার এক পরিচিত তাঁকে ফোন করে বিষয়টি জানান। যা শুনে বিস্মিত বঙ্গবাসী কলেজের শিক্ষিকা। আনন্দবাজার অনলাইনকে পায়েল বললেন, ‘‘জানতে পেরে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি ভাবতেও পারিনি যে, এত নামী শিল্পীর গলায় এই গানটি থাকলেও আমার গান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেয়ার করবেন! তা-ও এই গানটি নতুন গাওয়া এমন নয়। বছর সাতেক আগে গানটি অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গান এখন প্রধানমন্ত্রী শেয়ার করলেন ভেবে ভাল লাগছে।’’
রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বাঙালি পায়েলের কণ্ঠে নজরুলগীতি ‘শেয়ার’ করা এবং তার সঙ্গে বাংলার মানুষের ‘প্রভু শ্রীরামের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা’র কথা উল্লেখ করার বিষয়টি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। মোদী যে দিন সকালে রামন্দিরের উদ্বোধন করবেন এবং রামলালার মূর্তিতে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করবেন, সে দিনই দুপুরে কলকাতায় ‘সংহতি মিছিল’-এর ডাক দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মিছিলে সমস্ত ধর্মাবলম্বীরা যোগ দেবেন। হাজরা থেকে শুরু হয়ে ওই মিছিল শেষ হবে পার্ক সার্কাসে। সেখানকার মঞ্চেও কোনও রাজনীতিক থাকবেন না বলেই খবর। অর্থাৎ, মমতা রামমন্দিরের বিরোধিতা না করলেও তিনি নিজের মতো করে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিতে চাইছেন। অর্থাৎ পক্ষান্তরে, বাংলার মানুষকে মমতা বলতে চাইছেন, রামমন্দিরের মোড়কে মোদী তথা বিজেপি একটি ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন।
সেই প্রেক্ষিতেই বঙ্গতনয়া পায়েলের গানকে মোদী বেছে নিয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। প্রথমত, গায়িকা বাঙালি। দ্বিতীয়ত, গানের লেখক বাঙালি এবং তদুপরি মুসলিম। লোকসভা ভোটের আগে রামমন্দিরের উদ্বোধনের মাধ্যমে গোটা দেশে ‘মন্দির-হাওয়া’ তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি। বাংলায় তারা মমতার প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। সেই কারণেই দেশের বিভিন্ন শহর থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত সরাসরি বিমান পরিষেবা চালু হলেও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হাতে কলকাতা-অযোধ্যা উড়ানের বোর্ডিং পাস তুলে দেওয়া হয়। অনেকে বলছেন, একই উদ্দেশ্যে রামলালার মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে বাঙালি গায়িকার গাওয়া ‘সংখ্যালঘু’ নজরুলের রামবন্দনা শেয়ার করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বঙ্গবাসীদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মোদী।
যদিও এই বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন বঙ্গবাসীর শিক্ষিকা পায়েল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি পায়েলের কথায়, ‘‘ভারতীয় সঙ্গীতের পরম্পরায় এটা নতুন কিছু নয়। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি থেকে শুরু করে উস্তাদ বিসমিল্লা খান— হিন্দু ধর্মের কথা যদি বলেন, তা হলে এই মানুষগুলোকে বাদ দেবেন কী করে! নজরুলের রামধুন শুনলে চোখ ভেজে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সঙ্গীতে কোনও ধার্মিক ভেদাভেদ কাজ করে না। সুরের মূর্ছনা আসলে সঙ্কীর্ণ বিভাজনের অনেক ঊর্ধ্বে।’’ পায়েলের স্বামীও উচ্চশিক্ষার সঙ্গেই যুক্ত। ঘরে চার বছরের সন্তান রয়েছে। ঘর-সংসার-কলেজ সামলেও তানপুরার সঙ্গে নিয়মিত ‘রিয়াজ’ করেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই নিয়মনিষ্ঠ ভাবে গানের চর্চা করেছেন পায়েল। সে চর্চা এখনও চলছে। ছ’বছর বয়সে প্রথম গান শিখতে যাওয়া দেবীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তার পরে সংযুক্তা ঘোষের কাছে বহু দিন তালিম নেন। বর্তমানে পায়েল গান শিখছেন বিদূষী শুভ্রা গুহের কাছে। ভারতীয় মার্গসঙ্গীত হোক বা রবীন্দ্রনাথের গান— পায়েলের রিয়াজ করা গলায় খোলে সব ধরনের গান। তবে নজরুল একটু বেশি কাছের। প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর গাওয়া নজরুলগীতি ‘শেয়ার’ করায় বিস্ময়ের পাশাপাশিই আনন্দিত পায়েল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy