Advertisement
২২ মে ২০২৪

বয়ান বদল থেকে বয়ান লেখানো, চাপ পুলিশেরই

এক দিকে অভিযোগকারিণীকে রাতভর থানায় আটকে রেখে বয়ান বদল করতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ। অন্য দিকে অভিযুক্তের নিরক্ষর স্ত্রীর টিপসই দেওয়া বয়ান লিখে অভিযোগকারিণীকেই পাল্টা প্যাঁচে ফেলার চেষ্টার অভিযোগ। মালদহের ইংরেজবাজারে এক বিধবা মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টা ও তাঁর বাবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় এমন জোড়া অভিযোগের মুখে খোদ জেলা পুলিশ! তদন্তের আগেই জেলার মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলে দিয়েছিলেন, আদৌ ধর্ষিতা হননি মহিলাটি। বলেছিলেন, যা হয়েছে, তা পারস্পরিক সম্মতিতেই।

পীযূষ সাহা
মালদহ শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

এক দিকে অভিযোগকারিণীকে রাতভর থানায় আটকে রেখে বয়ান বদল করতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ। অন্য দিকে অভিযুক্তের নিরক্ষর স্ত্রীর টিপসই দেওয়া বয়ান লিখে অভিযোগকারিণীকেই পাল্টা প্যাঁচে ফেলার চেষ্টার অভিযোগ।

মালদহের ইংরেজবাজারে এক বিধবা মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টা ও তাঁর বাবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় এমন জোড়া অভিযোগের মুখে খোদ জেলা পুলিশ!

তদন্তের আগেই জেলার মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলে দিয়েছিলেন, আদৌ ধর্ষিতা হননি মহিলাটি। বলেছিলেন, যা হয়েছে, তা পারস্পরিক সম্মতিতেই। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওই মহিলা অভিযোগ করেন, জবানবন্দি নেওয়ার নামে তাঁকে মঙ্গলবার দুপুর থেকে বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ইংরেজবাজার থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। দফায় দফায় চাপ দিয়ে পুলিশ লিখিয়ে নিতে চেয়েছে যে, রিন্টু শেখ নামে ওই যুবকের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদেই সহবাস করেছিলেন তিনি।

অর্থাৎ ঠিক যে কথা বলেছিলেন কৃষ্ণেন্দুবাবু!

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতরের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু এ দিন পাশে পেয়েছেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজাকে। যিনি বলেছেন, “ওই মহিলার বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর অভিযোগের বয়ান মিলছে না।” শুধু মন্ত্রীরা নন, মালদহের পুলিশ সুপার পর্যন্ত অভিযোগকারিণীর প্রায় সমস্ত কথাই খারিজ করতে মরিয়া। যদিও অভিযুক্ত রিন্টু শেখের স্ত্রীর দাবি, তাঁর স্বামীর সঙ্গে অভিযোগকারিণীর কোনও অবৈধ সম্পর্ক ছিল না।

তৃণমূল সমর্থক রিন্টুকে অবশ্য বুধবার সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেই পুকুরিয়া থানায় রিন্টুর স্ত্রীর তরফে ওই মহিলার বিরুদ্ধেই পাল্টা অভিযোগ দায়ের হয়েছে। পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, রিন্টুর স্ত্রী মিনা বিবি ওই মহিলার বিরুদ্ধে রিন্টুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে টাকা আদায় ও ফোন করে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। ওই বিধবা মহিলা সোনা আদায়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন বলেও নাকি দাবি করেছেন রিন্টু।

কিন্তু মিনা তো লেখাপড়াই জানেন না! তিনি অভিযোগ দায়ের করলেন কী করে?

এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে মিনা বলেন, তাঁকে স্বামীর গ্রেফতারের বিষয়টি জানিয়ে টিপসই দিতে বলে পুলিশ। সেই সাদা কাগজে কী লেখা হয়েছে তাঁর জানা নেই। এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ রিন্টুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সাড়ে ১০টা নাগাদ মিনা ও তাঁর দুই সন্তানকে পুকুরিয়া থানায় নিয়ে যায় পুলিশই। সেখানে প্রায় সারাদিনই তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়।

অভিযোগকারিণী বিধবা মহিলার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মিনা বলেন, “ওই মহিলা আমাদের বাড়িতে কয়েক দিন রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে ওঁর তো কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই। মহিলা ভাল ও পরিশ্রমী। পুলিশ কী লিখে আমাকে দিয়ে টিপসই দিয়েছে তা জানি না।” পুলিশ তাঁর বয়ানে ওই মহিলার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পর্ক, টাকা আদায়, সোনা চাওয়ার অভিযোগ এনেছে শুনে মিনা বলেন, “আমি লেখাপড়া জানি না। টিপসই দিয়ে দায় সেরেছি। পরে কী হয়েছে জানি না।” পুকুরিয়া থানার ওসি প্রদীপ সরকারের দাবি, “ওঁর স্বামীকে গ্রেফতারের পর তা ওই মহিলাকে জানানোর জন্য টিপসই দিয়ে কাগজ দেওয়া হয়েছে।”

অভিযোগকারিণী এ দিন বিকেলে বলেন, “মন্ত্রী অভিযুক্তের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার সঙ্গে ওই যুবকের সম্পর্ক প্রমাণ করার জন্য পুলিশ সারারাত থানায় রেখে দিল। শুধুমাত্র চা-বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়েছে। এখন বয়ান বদলের জন্য নানা ভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে।” পুলিশ সুপারের অবশ্য দাবি, ওই মহিলাকে থানায় ডাকা হলেও আটকে রাখা হয়নি। তিনি তেমন কোনও লিখিত অভিযোগও করেননি।

গত ৯ জুলাই প্রথম বার থানায় রিন্টুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ লিখিয়েছিলেন ওই মহিলা। সে বার পুলিশ ও স্থানীয় তৃণমূল নেতারা থানাতেই সালিশি করে অভিযুক্তের থেকে টাকা আদায় করেন। রিন্টুর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। মহিলাটির দাবি, তাঁর সঙ্গে রিন্টু শেখের ভালবাসার সম্পর্ক থাকলে তা গ্রামের লোক জানত। কেউ কিছু জানে না, কেবল বাইরে থেকে তৃণমূলের কিছু লোকই তা জানছে, এটা কী করে সম্ভব? কার্যত কৃষ্ণেন্দুর বয়ানই পুলিশ তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ করে মহিলাটি বলেন, “পুলিশ ও তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, আমার সঙ্গে কারও অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপার নেই। রিন্টু আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। আমার বাবাকে খুনের চেষ্টা করেছিল। চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। এটা গাঁয়ের কারও অজানা নয়। যদি নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, সব কিছুই সামনে আসবে।”

এ দিন বিকেলে জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী মৌসম বেনজির নূর হাসপাতালে ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে পুলিশি হেনস্থার কথা বিস্তারিত ভাবে জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন মহিলাটি। মৌসমের অভিযোগ, “মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে জেলা পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওই যুবকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের তুলে মহিলাকে হেনস্থা করা হচ্ছে।”

অভিযোগকারিণী অবশ্য প্রত্যয়ী। তিনি বলেছেন, “আমি হাল ছাড়ব না। আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলেও বয়ান বদলানো যাবে না। পুলিশ তো সারারাত সে চেষ্টা করেছে।

পারেনি। পারবেও না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE