দত্তপুকুরের বিস্ফোরণস্থল। —ফাইল চিত্র।
এ যেন ‘পুষ্পা’ ছবির কাহিনি! দক্ষিণী সেই ছবিতে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে পুষ্পা রক্তচন্দন কাঠ সংগ্রহ করে তা একাধিক সীমানা পোস্ট, নাকা তল্লাশি পার করে পৌঁছে দিত ক্রেতাদের হাতে। দত্তপুকুর বিস্ফোরণের তদন্তে প্রাথমিক ভাবে জানা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও বাজির কাঁচামাল আসত অন্য জেলা বা অন্য রাজ্য থেকে, তেমনই তৈরি বাজি-পটকা যেত ভিন্ রাজ্যে। জেলার সীমানায় নাকা চেকিং, রাজ্যের সীমানায় নজরদারি পার হয়ে তা বাইরে যেত। বেআইনি বাজি ব্যবসায়ী থেকে গাড়িচালক, সকলেরই বক্তব্য, ‘জলপানি’ দিলেই আর চেকিং হত না। একটি মহলের অনুমান, মূল পাণ্ডাদের সঙ্গে প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির যোগসাজশেই তা সম্ভব হত। তবে তদন্তকারীদের বক্তব্য, তদন্ত চলছে, এই নিয়ে বলার মতো পরিস্থিতি এখনও হয়নি।
তদন্তের সূত্রে এর মধ্যেই কয়েক জনের নাম সামনে এসেছে। যেমন, সূত্রের দাবি, দত্তপুকুরে কাঁচামাল সরবরাহ করত নজরুল ও তার সাগরেদরা। শাসক ও বিরোধী, সব দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এলাকায় যারা বাজির ব্যবসায় জড়িত, তারা ভিন্ জেলা ছাড়াও আরও ছয় থেকে আটটি রাজ্যে বাজি পাঠাত। তাদের হাতের কাজ এমনই যে, তাদের বাজির বাক্সের উপরে যে লেবেল সাঁটা থাকত, তাই দেখে বোঝা যেত কোন কারখানায় তা তৈরি হয়েছে বা কার জিনিস এটা। স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ তখন সেই সব জিনিসে হাত দিত না। আরও জানা যাচ্ছে, বিশেষ তল্লাশি চললে, তার থেকে বাঁচতে গাড়িতে বাজির বাক্সগুলি ঢেকে দেওয়া হত পেঁপে, পেঁয়াজ, আলু, চাল, চিনির বস্তা দিয়ে। বিভিন্ন থানা এলাকায় রাস্তায় টহল দেওয়া পুলিশের কাছে সে সব গাড়ির নম্বর পাঠিয়ে দিত চক্রের মাথারা। তাতেই কাজ সারা হয়ে যেত। এ ভাবেই অসম, ত্রিপুরা, বিহার, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, কেরল, মধ্যপ্রদেশের মতো এলাকায় পৌঁছে যায় দত্তপুকুরের বাজি।
এলাকায় শুধু নারায়ণপুরেই সরকারি ভাবে বাজি তৈরির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই এলাকার এক বাজি ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘যারা পিছন থেকে টাকা লগ্নি করে, মাসোহারা নেয়— তারা থেকে যায় আড়ালেই।’’ কাকে কত টাকা দিতে হয়? এ প্রশ্নের জবাবে সকলেরই মুখে কুলুপ। তবে শাসক-বিরোধী সব দলের কাছেই মাসোহারা পৌঁছয় বলে জানালেন অনেকে।
পুলিশ সূত্রের দাবি, বাজি তৈরির মশলা কেনাবেচা করতে পারে অনুমোদিত সংস্থাই। জানা গিয়েছে, দত্তপুকুরের বেআইনি বাজি কারখানায় মশলা আসে মূলত কালোবাজার থেকে। কলকাতা ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ থেকেও আসে মশলা। মজুত রাখা হয় উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪পরগনার বিভিন্ন বাগানবাড়িতে। ক্রেতাদের সেখান থেকেই পাঠানো হয় মশলা ও রাসায়নিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাজি ব্যবসায়ীর দাবি, পুলিশের তৈরি করা পথেই দত্তপুকুরে ঢুকত কালোবাজার থেকে কেনা বাজি তৈরির কাঁচামাল। কোথায় কোথায় বাজি তৈরি হয়, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা তা জানেন বলেই অভিযোগ। বাজির কাঁচামাল পুলিশ রাস্তায় টহলদারির সময়ে ধরেছে— এমন নজির গত বেশ কয়েক বছরে মনে করতে পারেননি দত্তপুকুরের ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই মুখে তালা শাসক তৃণমূলের। স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রথীন ঘোষ তো ঘটনার দিন বলেই দিয়েছিলেন, বেআইনি বাজি কারবারের কথা জানতেনই না তিনি। সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার বলেছিলেন, এর আগে বেআইনি বাজি কারবার নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তবে তাতে কাজের কাজ যে কিছু হয়নি, তা বোঝা গিয়েছে ৯টি প্রাণের বিনিময়ে। পুলিশ আধিকারিকদের দাবি, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বাজি বহনকারী একটি গাড়ির চালকের কথায়, ‘‘আমরা তো মন্ত্রীদের গাড়ির মতো আরামে যাই। পথে কিছু চেকিং পয়েন্টে জলপানির টাকা গুঁজে দিতে হয়। সব রাজ্যে একই বন্দোবস্ত!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy