ক্রেতার অপেক্ষা। শুক্রবার সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি।
কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে ডুমুরশোল গ্রামের বাড়ি থেকে চৌডল নিয়ে বেরিয়েছিলেন মুগা যোগী। বেলা বাড়লে পুরুলিয়া শহরের স্টেডিয়াম মোড়ে রাস্তার পাশে জায়গা মিলবে না। কিন্তু সাত সকালে রঙিন চৌডলের পসরা সাজিয়ে বসাই সার হল। বেলা সাড়ে বারোটাতেও তাঁর বউনি হয়নি। খানিক তফাতে পসরা সাজিয়েছেন শহরের ভাটবাঁধ এলাকার বাসিন্দা মাণিক যোগী। স্বামীকে সাহায্য করতে স্ত্রী সন্তোষীদেবীও এসেছেন। তাঁদেরও অবস্থা একই রকমের।
অথচ, বছর দুয়েক আগেও টুসু পরবের আগের দিন এই বাজার থিকথিক করত ভিড়ে। এ বারে ক্রেতার পাত্তা নেই। বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে প্রৌঢ়া মুগাদেবী বলেন, ‘‘পরবের সময় চৌডল বিক্রি করে দু’পয়সা পাই। এ বছর মাত্র চল্লিশটা চৌডল এনেছি। কিন্তু এ রকমের খারাপ বাজারের অবস্থা আগে কখনও দেখিনি।’’ মাণিক যোগীও চৌডল বিক্রি করে আসছেন আজ নেই নেই করে হলেও কুড়ি বছর ধরে। বলেন, ‘‘আমার কাছে বড় চৌডল পাওয়া যায় অনেকেই জানে। সেগুলোর দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতাও রয়েছে। এ বারও দু’শো-আড়াইশো টাকার কয়েকটা চৌডল বানিয়েছিলাম যত্ন করে। কিন্তু ছোট-বড় কিছুরই কদর নেই।’’ দু’শো টাকা তো অনেক! শহরের টিকাপাড়া এলাকার শিল্পী খেদন দাস চৌডল বানিয়ে আসছেন যখন তার এক একটার দাম ছিল তিন টাকা। শ’দেড়েক চৌডল নিয়ে বাজারে বসে সেই সমস্ত দিনের কথাই বলছিলেন তিনি।
পুরুলিয়ার প্রাণের টুসু পরবে কেন বাজার নেই চৌডলের? মুগাদেবীর বলেন, ‘‘খদ্দেরই কম। এক আধজন এলেও নেড়েচেড়ে, দাম জিজ্ঞেস করে ফিরে যাচ্ছেন। এমন দর বলছেন, যে বানানোর পয়সাটুকুও উঠবে না।’’ আর এক বিক্রেতা গুরুপদ দাসও জানান, রঙিন কাগজ, কাগজের ফুল সব কিনে যে সুন্দর শিল্পটি সাজিয়ে তোলেন যত্নে তার দাম তো দূর, পরিশ্রমের দামও মিলছে না এ বারের বাজারে।
এমন পরিস্থিতি কেন? দরদস্তুর করার ফাঁকে কাজলা কৈবর্ত নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘‘ঘরে কাজ নেই। পয়সা নেই হাতে। কিন্তু আমাদেরও কি সাধ হয় না পরবের দিনে চৌডল ঘরে নিয়ে যেতে। দেখি যদি একটু সস্তায় মেলে।’’ আর এক ক্রেতা রঞ্জিত দত্তের মতে, নোট বাতিলের পরে বাজারে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে তার জেরেই হতে পারে এই অবস্থা। তাঁর মতে, কারও হাতে পয়সা নেই, কারও থাকলেও মনে সেঁধিয়ে গিয়েছে রুজি হারানোর ভয়। এই পরিস্থিতিতে সবাই চাইছেন যতটা রয়ে সয়ে খরচ করা যায়, তাই করতে।
পরবের বাজারে ঘুরছিলেন আড়শা কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক নিশিকান্ত মেহেতা। তিনি বলেন, ‘‘ধান হয়েছে, কিন্তু বিক্রি করবে কোথায়? নোট বাতিলে নগদও হাত পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। সে কারণেই বোধহয় এই অবস্থা।’’ দরদাম করে চৌডল কিনে ফেরার পথে কবি নির্মল হালদার বাজারে উসকে দিয়ে গেলেন আরও একটা প্রশ্ন। বললেন, ‘‘বিনোদনের সংজ্ঞাটাও একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। সেটাও কিন্তু ‘নোট’ করা দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy