অবৈধ নির্মাণ সরিয়ে নিতে এলাকায় বিজ্ঞপ্তি।—নিজস্ব চিত্র।
এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে নতুন রাস্তা তৈরি শুরু হয়েছে। কিন্তু, সেই কাজই হঠাৎ থমকে গিয়েছে তৃণমূল উপপ্রধানের বাড়ির সামনে এসে!
যার জন্য অবৈধ দখলদারীকেই দুষছে এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। অভিযোগ, বারবার নোটিস দিয়েও গুটি কয়েক ওই নির্মাণ ভেঙে রাস্তার জন্য জমি দখলদারমুক্ত করতে পারেনি প্রশাসন। ওই নিয়ে ক্রমেই ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, মাত্র কয়েকটি দোকান ও বাড়ির কারণে রাস্তা তৈরির কাজ আটকে গিয়েছে। ওই সব অবৈধ নির্মাণের তালিকায় খোদ হেতমপুর পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান নীলোৎপল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িও রয়েছে। শাসকদলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পূর্ত দফতর পাছে পিছিয়ে আসে, এই আশঙ্কায় দু’ দু’বার এলাকার শ’পাঁচেক মানুষ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছে। তাঁদের দাবি, দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে অবৈধ নির্মাণ সরিয়ে প্রস্তাবিত রাস্তার কাজ শুরু করা হোক। অবৈধ নির্মাণ না ভাঙলে, রাস্তার কাজে বাধা দেওয়ার হুমকিও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ দিয়েছেন।
বাসিন্দাদের এই ক্ষোভের আঁচ পেয়ে পাঁচ দিনের চূড়ান্ত সময়সীমা দিয়ে সোমবার ফের নোটিস পাঠিয়েছে প্রশাসন। প্রশাসনের হুঁশিয়ারি, অবৈধ নির্মাণ না সরালে এ বার তা ভেঙে ফেলা হবে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, দুবরাজপুর শহরের যানজট সমস্যা এড়াতে এবং হেতমপুরবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে গত ডিসেম্বরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি রাস্তার কাজে হাত দেয় পূর্ত দফতর (সড়ক)। প্রথম রাস্তাটি দুবরাজপুরের কামারশাল মোড় থেকে হেতমপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে গিয়ে পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কে গিয়ে মিশছে। দৈর্ঘ্য সাড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার। এটি ‘ফিডার রোড’। হেতমপুর রাজবাড়ির একটু আগেই ওই রাস্তা থেকে আরও একটি ১.২ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি হচ্ছে। যেটি দুবরাজপুরের সাতকেন্দুরীর কাছে উঠবে। ওই রাস্তা হল ‘লিঙ্ক রোড’। দু’টি রাস্তাই ১৮ ফুট চওড়া হওয়ার কথা। বরাদ্দ খরচ প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
এ দিকে, লিঙ্ক রোড তৈরির কাজ শেষ। ফিডার রোড তৈরির কাজও বেশ কিছুটা শেষ। কিন্তু, বাকি থেকে গিয়েছে হেতমপুরের প্রতীচী পল্লি থেকে ডাঙালপাড়া পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তার কাজ। দখলদারদের কারণে যেখানে সমস্যা সব চেয়ে বেশি, তা হল হেতমপুর পঞ্চায়েত লাগোয়া হাতিতলা এলাকা। রাস্তা ১৮ ফুট চওড়া করতে হলে ওই এলাকার কমবেশি দশটি বাড়ি ও দোকান ভাঙা পড়বে। আর সমস্যাটা সেখানেই। যদিও প্রয়োজনীয় জরিপ করে মাসচারেক আগেই ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর অবৈধ নির্মাণগুলিকে চিহ্নিত করেছে। দখলদারদের নির্মাণ সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানিয়ে দিন সাতেক আগে নোটিসও জারি করেছিল প্রশাসন। কিন্তু, তাতে কোনও কাজ হয়নি। শেষে এ বার পাঁচ দিনের সময়সীমা দিয়ে ফের আর এক দফা নোটিস জারি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার রাস্তা নতুন করে তৈরি ও সম্প্রসারণের কাজ হতে চলেছে জানতে পেরেই প্রশাসনের দ্বারস্থা হয়েছিলেন বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ। তখনই তাঁরা সংশ্লিষ্ট দফতরকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, দখলদার হঠিয়ে এই অংশের কাজ সঠিক ভাবে (১৮ ফুট চওড়া) না করা পর্যন্ত এখানে রাস্তার কাজ করতে দেবেন না। সেই দাবিতে গত ১৭ ডিসেম্বর এবং গত ১৮ মার্চ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দু’ দু’টি আবেদনপত্রও তাঁরা জমা দেন। বাসিন্দাদের দাবি, ‘‘রাস্তা যখন হচ্ছে, তখন ভাল করে নিয়ম মেনেই হোক। তাতে সকলেরই লাভ।’’ তার পরেই অবৈধ নির্মাণ সরিয়ে ফেলার নোটিস জারি করা হয়। কিন্তু, গত মঙ্গলবার প্রথম নোটিস জারি করার সময় যাঁদের দোকান বা বাড়ি ভাঙা পড়ছে, সেই সব বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে মৃদু প্রতিবাদ আসে। হেতমপুরের তৃণমূল উপপুরপ্রধান নীলোৎপল চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বাধা দেওয়ার কথা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রথম বার জমির জরিপ সঠিক ভাবে করা হয়নি। সেই জন্যই অনেক বাড়ি বা দোকান ভাঙা যাচ্ছে। তাই আরও এক বার জরিপ করার জন্য প্রশাসনের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘নতুন জরিপের পরেও যদি দেখা যায় আমার বাড়ি রাস্তা দখল করে রয়েছে, অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলব।’’ সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের কাছে তিনিও রাস্তার সর্বত্র ১৮ ফুট চওড়া বজায় রাখা নিশ্চিত করার দাবি রেখেছেন।
অন্য দিকে, দখলদারির পাশাপাশি পূর্ত সড়ক দফতরের আধিকারিকেরা রাস্তা নির্মাণে আরও একটি বাধার কথাও বলছেন। আধিকারিকদের দাবি, নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা মেটানো হলেও বিদ্যুৎ দফতর রাস্তার উপরে থাকা বিদ্যুৎ খুঁটিগুলি সঠিক জায়গায় সরানোর ব্যবস্থা করেনি। বিদ্যুৎ দফতরের এই গাছাড়া মনোভাবও রাস্তা তৈরিতে সমস্যা তৈরি করছে বলে অভিযোগ উঠছে। যদিও বিদ্যুৎ দফতরের সিউড়ি ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়র তন্ময় মহাপাত্রের দাবি, ‘‘পূর্ত দফতর (সড়ক) তো সবে টাকা জমা করেছে। তবে, শীঘ্রই কাজে হাত পড়বে। ইতিমধ্যে নতুন খুঁটি এলাকায় পড়তে শুরুও করেছে।’’
জমি জরিপে ত্রুটির যে অভিযোগ উঠেছে, তা খণ্ডন করে দিয়েছে দুবরাজপুর ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক বিশ্বজিৎ ঘোষ। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘ভিত্তিহীন অভিযোগ। ওই এলাকায় সঠিক পদ্ধতি মেনে সঠিক ভাবেই আমাদের দফতর জমি জরিপ করেছে।’’ এ দিকে, হেতমপুরের ওই এক কিলোমিটার রাস্তা দখলমুক্ত করা নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাননি পূর্ত দফতরের (সড়ক) অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র সুনীতি বিশ্বাস। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের যা করণীয় তা করেছি। এ বার কাজ না হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। মহকুমাশাসক (সিউড়ি সদর) বিষয়টি জানেন।’’
ঘটনা হল, সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের উপস্থিতিতে সকলকে অবৈধ নির্মাণ সরিয়ে ফেলার অনুরোধ আগেই জানিয়েছিলেন মহকুমাশাসক (সিউড়ি সদর) অরুন্ধতী ভৌমিক। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আগের নোটিসগুলি জারির পরেও কাজ না হলে নিয়ম মেনে মহকুমাশাসক হিসাবে আমাকেও একটি নোটিস জারি করতে হবে। তবে, জরিপ নিয়ে কিছু বাসিন্দা যে আপত্তি তুলেছেন, তা এ নিয়ে এ দিনই একটি বৈঠক রয়েছে।’’ বৈঠকের পরেই রাস্তা-জট কাটাতে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy