রাস্তাজুড়ে দোকানের পসরা। যত্রতত্র চলছে গাড়ি পার্কিংও। পা ফেলাই দায় রঘুনাথপুরের নতুন রাস্তায়। ছবি: সুজিত মাহাতো।
রাজ্য সরকার শিল্পের মুখ হিসেবে তুলে আনার চেষ্টা করলেও রঘুনাথপুর শহরের নাগরিক পরিষেবা এখনও তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। ন্যূনতম পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও অনেক কাজ বাকি। সেই সব সমস্যা নিয়ে ফের পুরবাসীর সামনে চলে এসেছে আরও একটা পুরভোট।
রঘুনাথপুরবাসীর মতে, এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। ইতিহাস জানাচ্ছে, পুরুলিয়া জেলা তখন গঠন হয়নি। ১৭৭৩ সালে তত্কালীন পাঁচেট জেলার সদরের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল এই রঘুনাথপুরকেই। জেলার প্রাচীনতম আদালত গড়ে ওঠে এই শহরেই ১৭৮৩ সালে। আর ১৮৮৮ সালে গড়ে ওঠা রঘুনাথপুর পুরসভাও জেলার অন্যতম প্রাচীন পুরসভা। তবুও প্রাচীনত্বের তকমা সরিয়ে শহরের সৌন্দর্যায়ন ঘটিয়ে পরিকল্পিত ভাবে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি রঘুনাথপুরকে। অথচ সম্ভবনা ছিল না এমনটা নয়। পুরবাসীর একাংশের অভিযোগ, যাদের হাতে শহরকে নতুন রূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল, তাঁরা উন্নয়নের অভিমুখটাই তৈরি করতে পারেননি।
চার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তিন-চারটি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছিল রঘুনাথপুর পুরসভা। সেই সময়ে পুরএলাকায় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০০। সময়ের সাথে শহরের আয়তন বেড়েছে। বর্তমানে পুরশহরের ব্যাপ্তি প্রায় ১৩ বর্গ কিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩টি। শহরের জনসংখ্যা ২০১১ সালের জনগনণা অনুযায়ী ২৫,৯৩২। কিন্তু ২০১৩-২০১৪ সালে সুসংহত শিশুবিকাশ দফতরের সমীক্ষা অনুযায়ী, শহরে বাস করে কমবেশি ৩৫ হাজার মানুষ। এই প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন উঠছে এই বিশাল সংখ্যাক বাসিন্দাদের নাগরিক পরিষেবা দিতে বা শহরের সৌন্দর্যায়ন ঘটিয়ে পরিকল্পনামাফিক আধুনিক শহর হিসাবে আদৌ কি রঘুনাথপুরকে গড়া হয়েছে?
উত্তর খুঁজতে বেড়িয়ে পড়া যাক। থানার পাশ দিয়ে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া নতুনবাজার রাস্তাটি কার্যত হকারদের দখলে চলে গিয়েছে। দিনের ব্যস্ত সময়ে তো বটেই যে কোনও সময়েই রাস্তায় একটি গাড়ি ঢুকে পড়লেই চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। পুরবাসীর প্রশ্ন, গত ১২৭ বছরে একটা মার্কেট কমপ্লেক্স কি গড়া যেত না? তাহলে হকার সমস্যা অনেকটাই মিটত। পুরুলিয়া-বরাকর রাস্তার পাশে পূর্ত দফতরের জমিতে দোকান করে দিয়েও হকারদের পুনর্বাসন দেওয়া যেত। গত দশ বছর ধরে রঘুনাথপুরে পুরবোর্ড পরিচালনা করছে তৃণমূল। তার আগে অন্তত দুই দশক ধরে পুরসভা ছিল বামেদের দখলে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, দু’টি দলই শহরকে সাজাতে পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার দিকেই তাদের নজর ছিল। শহরের উন্নয়নে তারা নজর দেয়নি। এই শহরের বাসিন্দা তথা আইনজীবী দেবব্রত সরকার বলেন, “রাজ্যে যখন যে সরকার ক্ষমতায়, তখন রঘুনাথপুরেও সেই দলেরই পুরবোর্ড। অথচ উন্নয়নটাই হল না!”
বিদায়ী পুরপ্রধান মদন বরাট মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরির ক্ষেত্রে পুরসভার নিজস্ব জমির অভাবের কথা বলছেন। তিনি বলেন, “একসাথে ২০০-৩০০ ব্যবসায়ীকে দোকান করে দেওয়ার মতো নিজস্ব জমি পুরসভার নেই।” কিন্তু সিপিএমের প্রাক্তন পুরপ্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ১৯৯৮ সালে তাঁরা চেলিয়ামা রাস্তার পাশে প্রায় ৮০ ডিসমেল সরকারি জমি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছিল পুরসভা। তাঁর দাবি, “শুধুমাত্র টাকার অভাবে সেই সময়ে মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি করা সম্ভব হয়নি।” তাঁর মতে, “এখন পুরসভাগুলি বিভিন্ন খাতে প্রচুর অর্থ পাচ্ছে। সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকলে মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি করা কঠিন কাজ নয়।”
এই শহরে একটি পার্ক না থাকা নিয়েও কম দুঃখ নেই বাসিন্দাদের। বস্তুত শিশু উদ্যান নিয়ে পুরভোটের মুখে যথেষ্ট সরগরম এই পুরশহরের রাজনীতি। পুরসভা সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ১৩, ৮ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে পার্ক নির্মাণে প্রায় সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা পেয়েছিল পুরসভা। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ সেই টাকায় পার্ক গড়া হয়নি। অথচ ওই টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে।
পার্ক তৈরির টাকা কোথায় কী ভাবে খরচ হয়েছে, তথ্য জানার অধিকার আইনে একাধিকবার সেই বিষয়ে পুরকর্তৃপক্ষর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কাজলকৃষ্ণ সিংহ। তাঁর অভিযোগ, এর সদুত্তর তিনি পাননি। পুরপ্রধান অবশ্য দাবি করেছেন, পার্ক তৈরির টাকায় ওই তিনটি ওয়ার্ডে তিনটি পুকুরের পাশের জমিতে গার্ড ওয়াল এবং সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অল্প টাকায় পুরোদস্তুর পার্ক তৈরি সম্ভব নয়।” তবে পুরসভার একটি সূত্রের দাবি, পার্ক তৈরির টাকা অন্যখাতে খরচ করে ফেলেছে পুরসভা। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলেরই কাউন্সিলর বিষ্ণুচরণ মেহেতা বলেন, “আমার ওয়ার্ডে পার্ক তৈরির জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, তা আমিই জানি না।”
বস্তুত পুরশহরে নেইয়ের তালিকাটা বেশ দীর্ঘই। তবুই তারই মধ্যে শ্মশানঘাটের পরিকাঠামো নিয়ে বাসিন্দাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। বাসিন্দাদের টিপ্পনি, রঘুনাথপুরে মরেও শান্তি নেই। দু’টি শ্মশানেই ছাউনিটুকুও নেই। আবর্জনা ঢাঁই করে ফেলে রাখা হয় শহরে ঢোকার রাস্তাগুলির পাশে। তিন বছর আগে বিআরজিএফ (স্পেশ্যাল) প্রকল্পে রঘুনাথপুরে পানীয়জলের প্রকল্প তৈরিতে ১৭ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা পেয়েছিল এই পুরসভা। কিন্তু জলপ্রকল্প গড়া সম্ভব হয়নি। পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, জলপ্রকল্পের কাজের ৮০ শতাংশই শেষ হয়েছে। পাইপ লাইন পাতার জন্য রাজ্য সড়ক খোঁড়ার প্রয়োজন। সেই কাজ করবে পূর্ত দফতর। তারা কাজ শেষ করলেই জল সরবরাহ শুরু করা হবে।
বিরোধী দলনেতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কথায়, “শহরকে সাজাতে, আধুনিক করতে তৃণমূলের পুরপ্রধানের সদিচ্ছাই কোনও সময়ে চোখে পড়েনি।” বিরোধীদের অভিযোগের সারবত্তা যে রয়েছে তার প্রমাণ মিলছে খোদ পুরসভায় তৃণমূলের দলনেতা বিষ্ণুচরণ মেহেতার বক্তব্যেও। শাসকদলের এই বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “গত দশ বছর ধরে দলের যে অংশের হাতে পুরসভার দায়িত্ব ছিল দূর্ভাগ্যজনক ভাবে তাঁরা শহরের আধুনিকীকরণের অভিমুখটাই তৈরি করতে পারেননি।”
পাঁচ বছর আগেও যে সমস্যাকে সামনে রেখে ভোটে গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলি। এ বারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চলেছে রঘুনাথপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy