শোকার্ত: শ্রীতমার বাবা মৈনাক রায়। নিজস্ব চিত্র
সোয়াইন ফ্লুতে মৃত্যু হয়েছে এক বালিকার। গত দশ দিনে বাঁকুড়ার কোতুলপুর গ্রামীণ হাসপাতালে জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৯ জন। এলাকার বাসিন্দারা চিন্তিত। বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার সহ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অরবিন্দ হালদার বলছেন, ‘‘ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া হলে কী করতে হবে তার নির্দেশিকা রয়েছে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু-এর জন্য তেমন কিছু আমাদের কাছে নেই।’’ তিনি জানিয়েছেন, মৃত বালিকার সমস্ত তথ্য জোগাড় করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানো হচ্ছে।
বুধবার কলকাতার পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় পূর্ব নারায়ণপুরের শ্রীতমা রায়ের (৭)। বৃহস্পতিবার বাড়িতে বসে শ্রীতমার বাবা মৈনাক রায় বলছিলেন, ‘‘আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ছিল না আমার মেয়েটা। কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। কথা বলতে পারত না। জ্বরের সঙ্গে যে শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, সেটাও গোড়ায় বোঝা যায়নি।’’
অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন, ৪ সেপ্টেম্বর শ্রীতমার প্রথম জ্বর আসে। সঙ্গে সর্দি আর কাশি। দু’দিনেও কমেনি। ৬ তারিখ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আরামবাগে এক চিকিৎসকের কাছে। ওষুধ দেন তিনি। ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষা করে কিছু পাওয়া যায়নি। এ দিকে জ্বর ছাড়ছিল না। ওই চিকিৎসকের পরামর্শে ১১ সেপ্টেম্বর ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রথম থেকেই ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল শ্রীতমাকে। ১৩ তারিখ বিকেলে জানা যায়, সোয়াইন ফ্লু হয়েছে। ওষুধ শুরু হতে হতেই শারীরিক অবস্থার বেশ কিছুটা অবনতি হয়েছিল। বুধবার বেলা ১১টা নাগাদ সব শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, চিকিৎসা শুরু হতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।
পরশু, ২৩ সেপ্টেম্বর ছোট্ট মেয়েটা আটে পা দিত। দিনটার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। শ্রীতমার ঠাকুরদা শান্তিপদ রায়, ঠাকুমা আরতি রায় বলেন, ‘‘সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াত। সব ফাঁকা হয়ে গেল! এ বার থাকব কেমন করে?’’ বৃহস্পতিবার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে ঘন ঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন শ্রীতমার মা বনশ্রী রায়। তিনি হুগলির বদনগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শ্রীতমার বাবা মৈনাক কোতুলপুরের রামাইপণ্ডিত কলেজে আংশিক সময়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত, এই এলাকা থেকেই মেয়ে ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে । গ্রাম ভর্তি জ্বরের রোগী। কিন্তু একটা স্বাস্থ্যশিবিরও হচ্ছে না। গ্রামের আর কোনও মা-বাবার যাতে আমাদের মতো অবস্থা না হয়, এখন সেটাই শুধু চাই।’’
সহ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অরবিন্দবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘শুনেছি মেয়েটিকে আরামবাগের একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হত। তার কাছাকাছি শুয়োরের খাটাল আছে। সেখান থেকেও রোগ ছড়াতে পারে।’’ মৈনাক জানাচ্ছেন, গত মাস চারেক ধরে মাঝে মধ্যে আরামবাগ শহরের একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শ্রীতমাকে। সাকুল্যে আধ ঘণ্টা সে স্কুলে থাকত। তবে সেখান থেকে সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মানতে চাইছেন না তিনি। মৈনাক বলেন, ‘‘পাড়ায় অনেকেরই জ্বর হচ্ছে। আমাদের বাড়ির পরিচারিকাও জ্বরে আক্রান্ত।’’
শ্রীহর পঞ্চায়েতের পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামে প্রায় ২০০ পরিবারের বাস। বেশির ভাগ বাসিন্দাই কৃষিজীবী। গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, যত্রতত্র জল জমে রয়েছে। চারদিকে ঝোপ, জঞ্জাল। চন্দন চট্টপাধ্যায়, উদাস চক্রবর্তী, অশোক দাস, রামপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়রা বললেন, ‘‘প্রশাসন তো কোনও পদক্ষেপই করছে না। আমরা রীতিমতো আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’’
কোতুলপুর গ্রামীণ হাসপাতালে এ দিন দুপুরে গিয়ে বিএমওএইচ-এর দেখা মেলেনি। যাওয়া হয়েছিল বিষ্ণুপুরে, স্বাস্থ্য জেলার সহ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিসে। সেখান থেকে জানা গেল, ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২৯ জন জ্বর নিয়ে কোতুলপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সহ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অরবিন্দবাবু বলেন, ‘‘ওই অঞ্চলের মেডিক্যাল অফিসার আর আশাকর্মীদের বলা হয়েছে পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামে গিয়ে তথ্য নিতে। জ্বরের ব্যাপারে দ্রুত একটি স্বাস্থ্য শিবিরও করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy