মহম্মদবাজারের হাটগাছার জলপ্রকল্প।—নিজস্ব চিত্র।
রাস্তাঘাট ঠিক মতো সংস্কার হয় না, নিয়মিত জলও ছেটানো হয় না। এর ফলে প্রায় বছরভর ধুলো দূষণে জেরবার মহম্মদবাজারের পাথরশিল্পাঞ্চল এলাকা। এই ধুলো দূষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানীয় জল সঙ্কট। বিশেষ করে গরমের সময়ে এই জলসঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মাটির নীচে পাথর থাকায় এমনিতেই জলস্তরের অবস্থা ভাল নয়। তারপর বড় বড় পাথর খাদান ও গভীর নলকূপের কারণে এই সময় জলস্তর আরও নেমে যায়। অধিকাংশ নলকূপে জল ওঠে না। কুয়ো শুকিয়ে যায়।
এই জলসঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে ২০০২-০৩ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ওই এলাকার হাটগাছায় ‘হাটগাছা জল সরবরাহ প্রকল্প’র কথা ঘোষণা করে এবং ৩০৫ কোটি টাকা মঞ্জুরও হয়। ওই বছরই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কিছু কাজ বাকি থাকতেই বছর তিনেকের মধ্যে জল প্রকল্প চালু করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রকল্পের সুফল বাসিন্দারা বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মহম্মদবাজারের ভাঁড়কাটা ও হিংলো পঞ্চায়েতের অধীন পাথর শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ গ্রাম আদিবাসী অধ্যুষিত। এলাকার সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে স্থানীয় লোকজন ও আদিবাসী সংগঠন ‘জেলা আদিবাসী গাঁওতা’ নানা দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবিগুলির অন্যতম ছিল, পরিস্রুত পানীয় জল। অবশেষে ২০০২-০৩ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকার এই এলাকায় একটি জল প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে এবং ওই বছরই ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের হাটগাছায় ‘হাটগাছা জল সরবরাহ প্রকল্পের’ উদ্বোধন করেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব। প্রকল্প রূপায়ণের খরচ ধরা হয় ৩৮৫ কোটি টাকা। মন্ত্রী ঘোষণা করেন, দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্প রূপায়ণ করা হবে এবং এলাকার ২৫টি গ্রামের ৩৪টি পাড়ায় জল পৌঁছে দেওয়া হবে। এর মধ্যে হিংলো পঞ্চায়েতের জগৎপুর ও হরিণসিঙ্গা গ্রামের চারটি পাড়াও আছে। মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু হয়। পরিকল্পনা ছিল, হিংলোর ফুলপাহাড়ি গ্রাম লাগোয়া দাঁড়কা নদীতে পাম্প বসানো হবে। সেখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে হাফ কিলোমিটার দূরের ফুলপাহাড়িতে জল এনে পরিস্রুত করা, তারপর হাটগাছায় নির্মিত ৬০ হাজার গ্যালনের উচ্চ জলাধারে পাঠানো। এই জলাধার থেকে ২৫টি গ্রামের ৩৪টি পাড়ায় জল পৌঁছে দেওয়া। ২০০৫ সালের ১ জুন থেকে জল দেওয়া শুরু হয়।
ভাঁড়কাটার শালডাঙ্গা, জেটকেপাড়া, খোটেপাড়া, হাবড়াপাহাড়ি, ধনাপাড়া, গিরিজোড়, কেন্দ্রপাড়া, নতুনপাড়া, পাঁচামি, ভাঁড়কাটা, চাঁদা, কাপাসডাঙ্গার একাংশ, ঢোলকাটা, তেঁতুলবাঁধি, শোলগড়িয়া, চাপুড়িবাগান, হাটগাছা, জেঠিয়া, বুড়িতলা, ইছেডাঙ্গা ইত্যাদি ৩৪টি যায়গায় ট্যাপ কল বাসানো হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় কলের সংখ্যা একেবারেই কম বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এলাকাবাসী। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, দিনে একবার জল দেওয়া হত। ২০-২৫ মিনিট বড়জোর আধঘণ্টা জল দেওয়া হত। আবার কোনও কলে জল পড়ত না। যেমন সাগরবাঁধি গ্রামে কোনও দিনই জল পৌঁছয়নি। গাঁওতার তরফে জল প্রকল্পের দেখাশোনা করতেন হাবড়াপাহাড়ির সুকুমার সাহা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রকল্প শুরুর প্রথম থেকেই সাগরবাঁধি-সহ ৩-৪টি গ্রামে কোনও দিনই জল পৌঁছয়নি। আর চালু হওয়ার দু’চার মাস পর থেকে তো জল প্রকল্প একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। অধিকাংশ জায়গাতেই জল যায় না।’’ হাবড়াপাহাড়ি, হরিণসিঙ্গা ও বারমেসিয়া—এই তিন পঞ্চায়েতের সদস্য কার্তিক টুডু, সোমচাঁদ হেমব্রম ও মানি হেমব্রমরা বলেন, ‘‘এই এলাকায় যা কিছু হয় সবই ভোটকে কেন্দ্র করে।’’ সুকুমারবাবু বলেন, ‘‘এই প্রকল্পের ব্যাপারে আমরা প্রথমেই আপত্তি করেছিলাম। আমরা জানতাম, এই প্রকল্প থেকে কখনই জল সমস্যা দূর হতে পারে না। তিনটে পাম্প বসানো, ৬০ হাজার গ্যালনের জলাধার নির্মাণ করে এবং সামান্য ক’টা কল বসিয়ে এতগুলো গ্রামের মানুষের জলের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তারপর আবার বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকায় সংশ্লিষ্ট দফতর লাইন কেটে দিয়েছিল। ফলে মাঝে মধ্যে যেটুকু জলও মিলত বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়ায় দীর্ঘদিন জল সরবরাহ বন্ধ ছিল। গত বছর জেলাপরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর কাছে এ ব্যাপারে আমরা দরবার করার পরে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়। দু’টি ঠিকেদার সংস্থা প্রকল্পটি চালায়। তারপর কিছু দিন নিয়মিত জল দিলেও মাঝে মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যেত।’’
ঘনাপাড়ার অশোক মুর্মু, পাঁচামির লালা মুর্মু, গিড়িজোড়ের মঙ্গল হেমব্রম, বারোমেশিয়ার অনিল হাঁসদা, সাগরবাঁধির রামেশ্বর হেমব্রমরা বলেন, ‘‘অনেক আন্দোলন ও কাঠখড় পোড়ানোর পরে এলাকায় জল প্রকল্প হল ঠিকই, কিন্তু বাস্তবটা অন্য। কোথাও জল পৌঁছয় তো কোথাও পৌঁছয় না। কিছু বললেই ঠিকাদারের লোকজন বলে, পাথরের গাড়িতে জলের পাইপ লাইন ফেটে গিয়েছে। না হয় উঁচু এলাকার যুক্তি দেখায়।’’ গাঁওতা সম্পাদক রবিন সোরেন ও নেতা সুনীল সোরেন বলেন, ‘‘জেলাশাসকের কাছেও পরিস্রুত পানীয় জল ও হাটগাছা জল প্রকল্পের জন্য দাবি জানানো হয়েছে। উনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।’’ জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দেন। এ দিকে, একটি ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার রাজকুমার দাস বলেন, ‘‘জল পরিষেবায় ঘাটতি আছে। তবে গরমে জলস্তর নেমে যাওয়ায় জলের সমস্যা হয়। রাস্তা দিয়ে পাথর বোঝাই গাড়ি যাওয়ায় কোথাও কোথাও পাইপ লাইন বসে যায়। উঁচু নিচু এলাকার জন্যও অনেক জায়গায় জল পৌঁছয় না।’’
পিএইচই’র এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র অর্ধেন্দু দত্ত বলেন, ‘‘মানুষের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে জল প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। তবে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত কাজ চলে। পরিষেবা উন্নতির জন্য ২০০৯-১০ সালে আরও ১১৫ কোটি টাকা পাওয়া যায়। ফলে প্রকল্পটির খরচ দাঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকা। উঁচু নিচু এলাকার কারণে কোথাও কোথাও জল পৌঁছয় না।’’ গ্রামবাসীর একাংশের অভিযোগ, কিছু লোকজন বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের ইচ্ছে মতো পাইপ কেটে জল নেয়। তেমনি পাথর বোঝাই গাড়ির জন্য বহু জায়গায় পাইপ নষ্ট হওয়ার কারণে জল সরবরাহ ব্যাহত হয়। অর্ধেন্দুবাবু বলেন, ‘‘পাইপ লাইন সারানোর জন্য গত বছর ৭২ লক্ষ টাকা এসেছিল। ওই টাকায় যতটা সম্ভব পাইপ লাইন সারানোর কাজ হয়েছে। প্রচুর জল নষ্ট হওয়ার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই জল দেওয়ার সময় কমে যায়।’’ সভাধিপতি বলেন, ‘‘পরিকল্পনাটা ভুল ছিল। বিদ্যুৎ বিল বাকি ছিল। গত বছরই কিছু বকেয়া বিল মিটিয়ে ফের জল দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। ওই এলাকার জল সমস্যা কী ভাবে দূর করা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy