Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ভিড়ের মধ্যে কুকুর খুঁজল লালজিতকে

সাতসকালে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে থানায় ছুটে এসেছিলেন, স্ত্রীকে দুষ্কৃতীরা অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ জানাতে। আর রাতের মধ্যেই অপহৃতের সেই স্বামীকেই স্ত্রীর খুনি হিসেবে গ্রেফতার করল পুলিশ!

স্ত্রীকে খুন করে এই কুয়োয় ফেলা হয় বলে অভিযোগ। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

স্ত্রীকে খুন করে এই কুয়োয় ফেলা হয় বলে অভিযোগ। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৭:১৯
Share: Save:

২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর ছাতনা থানার সুরালডিহি গ্রামের বধূর দেহ মেলে কুয়োর মধ্যে। থানায় গিয়ে স্বামীর অপহরণের অভিযোগ।

কিন্তু পুলিশ কুকুর এসে মৃতার স্বামীকেই চিনিয়ে দিল।

দীর্ঘ জেরায় পরিকল্পনা করে খুনের কথা কবুল। ধৃত আরও দুই।

আদালতে চার্জশিট পেশ। ধৃতেরা জেলেই।

সাতসকালে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে থানায় ছুটে এসেছিলেন, স্ত্রীকে দুষ্কৃতীরা অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ জানাতে। আর রাতের মধ্যেই অপহৃতের সেই স্বামীকেই স্ত্রীর খুনি হিসেবে গ্রেফতার করল পুলিশ!

গত ডিসেম্বরের এই ঘটনার কথা উঠলে এখনও বিস্ময় ঝরে পড়ে ছাতনার পুলিশ কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের গলায়। দিনটা ছিল গত বছরের ৯ ডিসেম্বর। শীতের সকালে ছাতনা থানায় এসে স্থানীয় সুরালডিহি গ্রামের বাসিন্দা লালজিৎ পাশি পুলিশ কর্মীদের হাতজোড় করে বলেছিলেন— ‘‘যে ভাবেই হোক স্ত্রীকে খুঁজে দিন।’’

কী হয়েছে? পুলিশ কর্মীদের এই প্রশ্নের জবাবে লালজিৎ জানিয়েছিলেন, মাঝরাতে কয়েকজন দুষ্কৃতী তাঁর দরজার কড়া নাড়ে। কেউ বিপদে পড়েছে ভেবে তিনি দরজা খুলতেই দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ঢুকে তাঁর হাত-পা বেঁধে ফেলে। এরপর তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায় ওরা। পেশায় লালজিৎ খেজুর ও তালরস বিক্রেতা। আদপে তিনি বিহারের লোক। এখানে প্রতিপত্তিও তেমন নেই। এমন লোকের বাড়িতে কিসের টানে দুষ্কৃতীরা যাবে? আর লালজিতের স্ত্রীকেই বা কেন কেউ তুলে নিয়ে যাবে?— এই সব প্রশ্ন যখন পুলিশ কর্মীরা লালজিতের কাছে তুলছেন তখনই খবর আসে ছাতনা থানার কেশড়া এলাকার একটি কুয়োতে এক বধূর দেহ পড়ে রয়েছে।

পুলিশ কর্মীদের সন্দেহ হয়, ওই বধূর দেহ লালজিতের স্ত্রী-র নয় তো? তাঁরা লালজিৎকে নিয়েই কেশড়ায় ওই বধূর দেহ উদ্ধার করতে যান। কুয়োর পাশেই পড়েছিল বধূর শাড়ি ও গায়ের চাদর। দেহ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে লালজিৎ পুলিশকে জানিয়েছিল, দেহটি তারই স্ত্রী সীমা পাশির (২২)।

এক বধূকে রাতে দুষ্কৃতীরা অপহরণ করে খুন করে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে বলে খবর রটে যায়। এলাকাবাসীর ভিড় হামলে পড়ছে ওই কুয়োর আশেপাশে। ছাতনা থানার ওসি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক অমিতকুমার মান্না ছাড়াও বাঁকুড়া থেকে ঘটনাস্থলে তদন্তে যান ডিএসপি (প্রশাসন) আনন্দ সরকারও। তাঁরা পুলিশ কুকুর এনে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। কী কী হয় উদ্বেগে অপেক্ষা করতে থাকেন বাসিন্দারা।

পুলিশ কুকুর নিয়ে আসতেই পট পরিবর্তন। মৃতার দেহ ও কাপড়ের গন্ধ শুঁকে পুলিশ কুকুর ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে সোজা লালজিতের কাছে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার জুড়ে দেয়। কুকুরের হামলে পড়া দেখে লালজিতের মুখ ফ্যাকাসে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন পুলিশ আধিকারিকরা। তবে কি লালজিৎই নিজের স্ত্রীকে খুন করেছে? নিশ্চিত হতে পুলিশ কর্মীরা এ বার তাকে মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিয়ে যান।

তারপর ফের পুলিশ কুকুর নিয়ে তল্লাশি শুরু হয়। পুলিশ কুকুর ফের মৃতার দেহের গন্ধ নাকে নিয়েই লোকজনের ঘা ঘেঁষে ঘুরতে ঘুরতে লালজিতকে কাছে পেয়ে ফের চিৎকার জুড়ে দেয়। একই পরীক্ষা আরও কয়েক বার করেও ফল সেই একই দাঁড়ায়। পুলিশের সন্দেহের তির ঘুরে যায় লালজিতের দিকে। থানায় ফিরে এসে তদন্তকারীরা লালজিতকে কয়েক ঘণ্টা ধরে টানা জেরা শুরু করেন। লালজিতের জবাব অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় প্রশ্নে-প্রশ্নে আরও চেপে ধরা হয় তাকে। পুলিশের দাবি, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ভেঙে পড়ে লালজিৎ। পরিকল্পনা করেই নিজের স্ত্রীকে খুন করার কথা কবুল করে ফেলে সে। স্ত্রীকে মেরে ফেলার পরে নিজের অপরাধ ঢাকতে সে যে পরিকল্পনা করে থানায় এসেছিল তাও স্বীকার করে। ধরা পড়ে ওই খুনে জড়িত সন্দেহে আরও দু’জন।

কী ভাবে নিজের জালেই নিজে জড়িয়ে পড়ল লালজিৎ? পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, লালজিৎ তার স্ত্রীকে সন্দেহ করত। সীমা ফোনে কারও সঙ্গে ঘন ঘন কথা বলতেন। সেখান থেকেই এই সন্দেহের শুরু। ঘটনা এমন জায়গায় পৌঁছয় যে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় লালজিৎ। কিন্তু একার পক্ষে খুন করার ঝুঁকি বেশি। তাই অন্য পরিকল্পনা করে সে। তার কাছে কয়েক হাজার টাকা ধার করেছিল পড়শি গ্রাম ক্ষীরশোলের দুই যুবক অজয় বারুই ও সঞ্জয় পাল।

কিন্তু তারা ধার শোধ করতে পারছিল না। একদিন লালজিৎ তাদের ডেকে জানায়, পুরো টাকা সে মকুব করে দিতে রাজি আছে। তবে শর্ত একটাই— সীমাকে খুন করতে হবে ওদের। শর্তে রাজি হয়ে যায় অজয় ও সঞ্জয়।

এরপর আসে সেই রাত। তদন্তকারী পুলিশ কর্মীরা জানাচ্ছেন, লালজিৎ ও সীমার একটি বছর দুয়েকের সন্তান রয়েছে। মাঝরাতে মায়ের পাশে সে ঘুমোচ্ছিল। সীমাও ঘুমে মগ্ন। শুধু জেগেছিল লালজিৎ। অপেক্ষা করছিল অজয় ও সঞ্জয়ের জন্য। রাত ১২টার পরে অজয় ও সঞ্জয় এসে দরজায় টোকা মারতেই লালজিৎ গিয়ে দরজা খুলে দেয়। এরপর ঘুমন্ত সীমার গলা টিপে ধরে লালজিৎ। ছটপট করতে শুরু করেন সীমা। অজয় সীমার পা দু’টো জাপটে ধরে। সঞ্জয়ও খুনের কাজে হাত লাগায়। সীমা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায়।

চিৎকার চেঁচামেচিতে শিশু সন্তানটির ঘুম ভেঙে যায়। লালজিৎ ওই অবস্থায় ফের শিশুটিকে ঘুম পাড়ায়। এরপর সীমার দেহ মোটরবাইকে চাপিয়ে সঞ্জয় ও অজয় ফেলে দেয় ওই কুয়োয়। লালজিৎ নিজেই নিজের দু’টি পা দড়িতে বেঁধে পড়শিদের ফোন করে ডাকে। পড়শিরা এসে দেখে লালজিতের হাত খোলা, কিন্তু পা বাঁধা।

লালজিৎ দাবি করে, দুষ্কৃতীরা পিছমোড়া করে তাঁর হাত ও পা বেঁধে দিয়েছিল। এরপর নিজের হাত খুলতে পারলেও নিজের পা কেন খুলল না লালজিৎ? সেই প্রশ্নও তোলেন তদন্তকারীরা। সীমাদেবীর শিশু সন্তানটি আপাতত তাঁর বাপের বাড়িতে থেকে বড় হচ্ছে। ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পুলিশ চার্জশিট জমা করায় জামিন আটকে যায় লালজিৎ, অজয় ও সঞ্জয় তিনজনেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sniffer dog crowd
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE