Advertisement
১৯ মে ২০২৪

মাদক-সিগারেট ছড়াচ্ছে শহরে

থমকে শহর। পাওয়ার হাউস মোড়ের একটু আগে, যানজটের ভিড় এড়িয়ে অপেক্ষমান এক যুবক বারবার ঘড়ি দেখছে। ট্রাফিক নড়েনি, কিন্তু তারই মধ্যে পথ করে একটি মোটর বাইক এসে থামল যুবকের সামনে। সওয়ার দুই আরোহীর মুখ ঢাকা হেলমেটে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তারা দ্রুত ওই যুবকের হাতে কয়েকটা সিগারেট গুঁজে দিয়ে প্রাপ্য বুঝে হাওয়ার গতিতে চম্পট দিল। ওই যুবাও ততক্ষণে মিশে গিয়েছে পথের ভিড়ে।

পুলিশের নজর এড়িয়ে হাতে হাতে ঘুরছে নেশার পুরিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

পুলিশের নজর এড়িয়ে হাতে হাতে ঘুরছে নেশার পুরিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

থমকে শহর। পাওয়ার হাউস মোড়ের একটু আগে, যানজটের ভিড় এড়িয়ে অপেক্ষমান এক যুবক বারবার ঘড়ি দেখছে। ট্রাফিক নড়েনি, কিন্তু তারই মধ্যে পথ করে একটি মোটর বাইক এসে থামল যুবকের সামনে। সওয়ার দুই আরোহীর মুখ ঢাকা হেলমেটে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তারা দ্রুত ওই যুবকের হাতে কয়েকটা সিগারেট গুঁজে দিয়ে প্রাপ্য বুঝে হাওয়ার গতিতে চম্পট দিল। ওই যুবাও ততক্ষণে মিশে গিয়েছে পথের ভিড়ে।

না, এ কোনও ফিল্মি চিত্রনাট্য নয়। জেলা-শহর দুবরাজপুরের চেনা দৃশ্য। আর ওই সিগারেট মামুলি কোনও সিগারেটও নয়। মাদক ভর্তি সিগারেট। এলাকার নেশাড়ুদের কাছে যা কোড নাম বিএস।

চূড়ান্ত বাস্তব এই দৃশ্যের অহরহ সাক্ষী এখন দুবরাজপুর শহর। আর ব্রাউন সুগারের মত নারকোটিক ড্রাগ মিশ্রিত সিগারেটে আসক্ত শহরের বহু তরুণের ভবিষ্যত প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। এমন অনেকেই রয়েছেন এঁদের মধ্যে যে, দিনের মধ্যে কমপক্ষে একবার ওই সিগারেট ছাড়া তাঁদের কিছুতেই চলবে না। মরিয়া হয়ে, নেশাগ্রস্তরা নিজেরাই, কখনও বা মাধ্যম ব্যবহার করে মাদক মিশ্রিত সিগারেট জোগাড় করছেন। এই নেশাতেই এখন ঝিমোচ্ছে দুবরাজপুর।

শহরের যে সব তরুণ বা যুবা নেশার কবলে পড়েছেন, তাঁদের সকলেরই যে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভালো, তেমন নয়। নেশার জন্য টাকা জোগান দিতে অনেকে চুরি-ছিনতাইও করছে। কেউ কেউ পরিবারের টাকা পয়সা ছিনিয়ে বা, গহনা বিক্রি করেছে এমন নজিরও রয়েছে। এঁরা সকলেই ৩০০ বা ৫০০ টাকা দিয়ে এক একটি বিএস সিগারেট কিনে নেশা করছেন। নেশার কবলে পড়ে অনেক পরিবার আর্থিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি একই স্বচ্ছল পরিবারগুলিতেও। ইতিমধ্যেই অনেক অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের নেশামুক্তির জন্য মোটা টাকা খরচ করে রিহ্যাব ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ফল পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু দিন রিহ্যাব ক্যাম্পে থাকার পরও কয়েকজন নেশাসক্ত ফের মাদক-সিগারেট সেবন শুরু করেছেন। কেউ কেউ বন্ধু বান্ধবকে নতুন করে নেশার রাস্তায় টেনে এনেছেন। এমন উদাহরণ বহু রয়েছে। কিন্তু পরিবারের অসম্মান হয়, এই আশঙ্কায় কিছু বলতে রাজি হননি নেশাগ্রস্তদের পরিবারের লোকেরা। আসক্তেরা অবশ্য বলছেন, “জীবন শেষ হয়ে গেল। চেষ্টা করেও এখন আর নেশা থেকে দূরে থাকতে পারছি না!”

কোন পথে এই মাদক-সিগারেট নেশাড়ুদের হাতে পৌঁছচ্ছে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা বললেন, দুবরাজপুর, খয়রাশোল- সহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক পোস্ত চাষের কুফলের কথা। নারকোটিক্স কন্ট্রোলব্যুরো সূত্রে জানা গিয়েছে, নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে আর কোথাও পোস্ত চাষ সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও জেলার বিভিন্ন জায়গায় পোস্ত চাষ হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে প্রচুর ধরপাকড় ও নারকোটিক আইনে পোস্ত চাষিদের বিরুদ্ধে মামলা করায় এবং প্রশাসনিক নজরদারিতে পোস্ত চাষের লাগাম পড়লেও ২০০৩ সাল থেকে ব্যাপক বেআইনি পোস্ত চাষ হয়েছে এই জেলায়। এবং চাষের একটা বড় অংশই ছিল দুবরাজপুর ও খয়রাশোল ব্লকে।

পোস্ত চাষে এত রমারমার কারণ, প্রায় ৮০ হাজার টাকা কিলো দরে পোস্তর আঁঠার লোভ। জেলার বাইরে মাদক কারবারিদের প্রশ্রয়। কারণ পোস্তোর আঁঠার সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে মরফিন, ব্রাউনসুগার বা হেরোইনের মত মাদক তৈরি হয়ে থাকে। যে সব মাদক মানুষের প্রাণ সংশয় ঘটাতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে মানবদেহের নার্ভাস সিস্টেম।

ঘটনা হল, পুলিশের ভয়ে পাচার করতে না পারা পোস্তর আঁঠা থেকেই ব্রাউন সুগার বা হেরোহিন তৈরির মতো দুঃসাহসিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, খয়রাশোলের দহল, জুনিদপুর, ইদিলপুরে এমন কিছু কারবারি রয়েছে। তারই ফল ভোগ করছে দুবরাজপুর শহরের নতুন প্রজন্ম। দিন কয়েক আগেই খয়রাশোলের ওই এলাকা থেকে হেরোইন-সহ এক যুবক ধরা পড়েছে।

কীভাবে তৈরি হচ্ছে এই মাদক-সিগারেট?

১০ কিলো আঁঠা সংগ্রহ করতে পারলে নিষিদ্ধ রাসায়নিক মিশিয়ে ১ কিলো হেরোইন তৈরি সম্ভব। যার বাজার দর (আন্তর্জাতিক বাজারে) ১ কোটি টাকা। পোস্তর আঁঠা (ন্যাচারাল ড্রাগ)এর সঙ্গে চুন মিশিয়ে হয় মরফিন(যা সেমি সিন্থেটিক ড্রাগ)। মরফিনের সঙ্গে অ্যাসিটিক অ্যানহাইড্রেড মেশানো হলে তা হয় ব্রাউন সুগার। এবং এর পর যদি অ্যাসিটন মেশানো হয় তাহলে হয় পিওর হেরোইন। যার রঙ সাদা। অবৈধভাবে বা অনুমতি ছাড়া অ্যাসিটিক অ্যানহাইড্রেড বা অ্যাসিটন জাতীয় কোনও রাসায়নিক রাখাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ব্রাউনসুগার তৈরির সেই কৌশল রপ্ত করে সিগারেটে ভরে দুবরাজপুর-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে এই বিশেষ সিগারেট। দুবরাজপুর পাওয়ার হাউস মোড়, পাহাড়েশ্বর, সিনেমা হলের কাছাকাছি, কুলুপাড়া কালী মন্দিরর সংলগ্ন রাস্তা, সানাই অনুষ্ঠান ভবন এবং দুবরাজপুর স্টেশনের রাস্তায় দিনের বিভিন্ন সময় মাদক-সিগারেট নিয়ে হাজির হচ্ছেন কারবারিরা। অবশ্য তার আগে মোবাইলে গ্রাহকের সঙ্গে দর ঠিক হয়ে থাকে। দুবরাজপুর থানার পুলিশ একবার এমন সিগারেটের প্যাকেট বাজেয়াপ্ত করেছিল। স্থানীয়দের দাবি, সে তদন্ত শিকড় পর্যন্ত যায়নি। পুলিশ বিষয়টিতে সজাগ দৃষ্টি না দিলে সমস্যা জটিল হবে।

পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিএস নামক সিগারেটের নেশা করছেন এলাকার শতাধিক যুবক। দুবরাজপুরের পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে বলেন, “নেশা করার প্রবণতা মারাত্মক আকার নিয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য খুবই খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।”

কী বলছেন জেলা পুলিশসুপার?

জেলা পুলিশসুপার মুকেশ কুমার বলেন, “প্রথমে তদন্ত করে দেখতে হবে বিষয়টিকে। তবে অভিযোগের সতত্যা পেলে অবশ্যই এই কারবার পুরোপুরি বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেব। যারা এই সিগারেট তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE