অভিভাবকদের কাছে যাচ্ছেন শিক্ষকেরা। পাত্রসায়রে। নিজস্ব চিত্র।
‘মোবাইল আসক্তি’র কারণে স্কুলে আসছে না বহু পড়ুয়া! ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে অভিভাবকদের থেকে এমন কথাই শোনা গিয়েছে বলে দাবি বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের নাড়িচা সর্বমঙ্গলা বিদ্যাপীঠ স্কুলের শিক্ষকদের একাংশের।
গত ১৬ নভেম্বর রাজ্যে নবম-দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠন শুরু হয়েছে সব স্কুলে। পাত্রসায়রের ওই স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম ক’দিন স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি ঘোরাফেরা করেছে ৩০ শতাংশের আশেপাশে। কেন ৭০ শতাংশ পড়ুয়া স্কুলে আসছে না, তার কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন শিক্ষকেরা।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রত্যেক বছর ধান কাটা ও আলু বসানোর সময়ে স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি কম থাকে। কিন্তু অনুপস্থিতির হার এত বেশি হয় না। মঙ্গলবার স্কুলের সহ-শিক্ষকদের একটি দল বিভিন্ন গ্রামে যায়। বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিভাবকদের একাংশের সঙ্গে কথা বলে অবাক হতে হয় তাঁদের। মোবাইল আসক্তির কারণেই নাকি অনেকে স্কুল কামাই করছে। অভিভাবকেরাই এই দাবি করছেন।’’
নাড়িচা গ্রামের এক স্কুল পড়ুয়ার অভিভাবক বলেন, ‘‘আমরা পড়াশোনা তেমন একটা জানি না। ঠিকাশ্রমিকের কাজ করি। অনলাইন ক্লাস করার জন্য স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলাম। এখন মোবাইল দেখা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলের। স্কুল যেতে চাইছে না।’’ একই দাবি ন্যাকড়াকোন্দা গ্রামের এক স্কুল পড়ুয়ার বাবার। তিনি বলেন, ‘‘স্কুল এবং টিউশন— সবই স্মার্ট ফোনে হচ্ছিল। এখন দেখছি সারাক্ষণ ছেলে মোবাইলে গেম খেলেই কাটিয়ে দিচ্ছে। স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে না। আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’’
ওই স্কুলের শিক্ষক গোপাল পালের কথায়, ‘‘অনেক পড়ুয়াই শ্রমিক, কৃষক ও দিনমজুর পরিবারের। সকাল থেকেই তাদের অভিভাবকেরা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা তখন মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকছে।’’ তিনি জানান নাড়িচা, ন্যাকড়াকোন্দার মতো গ্রামের বেশ কিছু স্কুল পড়ুয়ার অভিভাবক জানিয়েছেন, লকডাউনের সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি বেড়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, এ-ও জানা গিয়েছে, অনেক পড়ুয়া ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়েছে। সে কারণে তারা স্কুলে আসতে পারেনি। তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের দশম-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তিনি বলেন, ‘‘অভিভাবকদের বোঝানো হয়েছে। তাঁরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলে কথা দিয়েছেন।’’ প্রধান শিক্ষকের দাবি, বুধবার সামান্য হলেও উপস্থিতির হার বেড়েছে।
বাঁকুড়ার লোকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোরাচাঁদ কান্ত বলেন, ‘‘আমাদের স্কুল-সহ জেলার অনেক স্কুলেই অল্পবিস্তর এই সমস্যা রয়েছে।’’ এই বক্তব্য সহমত শিক্ষক সংগঠনগুলিরও। এবিটিএ-র জেলা সম্পাদক অস্মিতা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এই সমস্যার কথা বেশ কিছু স্কুল থেকেই শোনা যাচ্ছে।’’ পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি গৌতম দাসের কথায়, ‘‘বেশ কয়েকটি সমস্যার মধ্যে পড়ুয়াদের মোবাইল আসক্তি অন্যতম। আমরা এ বিষয়ে অভিভাবকদের
সচেতন করছি।’’
এই সমস্যা নিয়ে মনোবিশ্লেষক মোহিত রণদীপ বলেন, ‘‘ক্লাসে পড়াশোনার থেকে মোবাইলে লেখাপড়া পড়ুয়াদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে। অনলাইনে পরীক্ষা হওয়ায় বই দেখে উত্তর লেখা বা অন্য কিছু সাহায্য নেওয়ার সুযোগ ছিল। সে কারণে, হয়তো পড়ুয়াদের মনে হচ্ছে, ক্লাসে ফিরে গেলে আর সে সুযোগ মিলবে না।’’ সঙ্গে জোড়েন, ‘‘মোবাইল আসক্তি বাড়লে কল্পনাশক্তি কমে যায়। একাগ্রতা, স্মরণশক্তি ও মনোসংযোগ কমে যায়। ক্ষতির দিকটি বুঝিয়ে বললে হয়তো এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy