পলিথিন শেডের নীচে মাথা তুলেছে পেঁয়াজের চারা। খয়রাশোলের রূপষপুরে ছবিটি তোলা। —নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যজুড়ে পেঁয়াজের দর যখন আগুন, খরিফ পেঁয়াজ চাষের এলাকা বাড়াতে ভিন্ন উদ্যোগ শুরু হল বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ও বীরভূমের খয়রাশোলে।
আগ্রহী একটি কৃষক গ্রুপকে এ ব্যাপারে সরাসরি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারের কৃষি বিপণন দফতরের প্রকল্প সুফল বাংলা। সহযোগিতায় রয়েছে কৃষি দফতরও। সুফল বাংলা-র প্রকল্প আধিকারিক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পেঁয়াজ চাষে বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলার সম্ভাবনা উজ্বল। সেই কথা মাথায় রেখে ওই দু’টি জেলার মহকুমা কৃষি আধিকারিকদের সাহয্যে দুটি কৃষক গ্রুপকে বেছে, ব্লকে ছোট্ট আকারে প্রদর্শন ক্ষেত্র করা হয়েছে।’’
যে জমিতে ধান চাষ নিশ্চিত নয়, সেই জমিতে বর্ষার পেঁয়াজ চাষ করা যেতে পারে। দু’একটি সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারলেই ফলন নিশ্চিত। কৃষি আধিকারিকের বলছেন, বিঘা প্রতি প্রায় ৩০ ক্যুইন্টাল পর্যন্ত ফলন পাওয়া যাবে এই চাষে। যে পরিমাণ বাজার দর উঠছে পেঁয়াজের, তাতে সেটা যথেষ্ট লাভজনক। সঙ্গে জেলায় খরিফ পেঁয়াজের এলাকা অনেক বাড়বে। তার উপর সুফল বাংলা প্রকল্পে যদি বিক্রির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই চাষিদের কাছে সেটা আশাব্যঞ্জক।
এ বছর বীরভূম জেলায় মোট খরিফ পেঁয়াজ চাষ হয়েছে প্রায় ৩০০ বিঘায়। খয়রাশোলের রূপষপুর পঞ্চায়েত এলাকার বড়ঘাটা কৃষি উন্নয়ন সমিতিকে ১০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগানোতে প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ হয়েছে ওই প্রকল্পের আওতায়। অন্যদিকে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকের ছোট শালবনিতেও ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি নির্ভর খরিফ পেঁয়াজচাষের জন্য বীজতলা তৈরি। নবদিশা গ্রুপ অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি শালবনিতে এই চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। ঠিক হয়েছে, কৃষি বিপনণ দফতর উৎপাদিত এই পেঁয়াজ চাষিদের কাছে থেকে কিনে নেবে বাজারদরে। সবে চাষে হাত দেওয়া গ্রুপের দশজন চাষিকে প্রতি মুহূর্তে পরামর্শ দিয়ে চলেছে কৃষি দফতর। সঙ্গে রয়েছে নজরদারি।
কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এর পিছনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমত একটি ভ্যালু চেন তৈরি করা। অর্থাৎ জমি প্রস্তুত থেকে বীজতলা তৈরি, চাষে সার অনুখাদ্য ব্যবহারের খরচ, উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খরচ কত। এবং উৎপাদিত ফসল বিক্রি হওয়ার সময় কৃষক কী দাম পাচ্ছেন, কত টাকাই বা লাভ হচ্ছে কৃষকের, এই সব তথ্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি বিপনণ দফতর।
ঘটনা হল, এসব অঙ্ক জানার পর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে পরবর্তী কালে চাষের এলাকা বাড়ানোর কথা ভাববে বিপনণ দফতর। দ্বিতীয়ত, কৃষকের উৎপাদিত ফসল উপযুক্ত দামে যাতে বিক্রি করতে পারেন সুনিশ্চিত করা। দফতর সূত্রের খবর, পেঁয়াজ চাষ মূলত উদ্যানপালন দফতরের আওতাধীন হলেও ব্লকস্তরে নিয়মিত নদরদারি ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য কৃষি দফতরকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার দুটি জায়গার মধ্যে খয়রাশোলের বড়ঘাটা অন্যতম।
রূপষপুর পঞ্চায়েত এলাকার বড়ঘাটা কৃষি উন্নয়ন সমিতির দলনেতা সজল মণ্ডল। চলতি বছরের শুরুতে একটি বেসরকারি কয়লাখনি সংস্থার ঠিকা কাজ হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। একই সঙ্গে বেকার হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দুই দাদাও। নিজেদের পরিবারিক চাষ-আবাদকে আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করবেন স্থির করলেও দেখেন যে পরিমান কৃষিজমি থাকলে স্বচ্ছন্দে চলে, ততটা পরিমান জমি তাঁদের পরিবারের হাতেই নেই। এর পরই তাঁদের গ্রুপ তৈরির ভাবনা চিন্তা শুরু হয়।
পেঁয়াজ চাষ করার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে থাকেন সজলবাবুরা। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমেই ঠিক করেছিলাম অন্য চাষ যাই করি না কেন বর্ষার পেঁয়াজ চাষ করব। গ্রুপের সদস্যরা মিলে লিজে অন্য কৃষকদের কাছে থেকে নিশিন্তা মৌজায় ১০ বিঘা জমি নিই। প্রথমে উদ্যানপালন দফতরের শিবির থেকে ১ কেজি পেঁয়াজ বীজ কিনেছিলাম। এত বড় আকারে চাষ করব শুনে এগিয়ে আগে কৃষি দফতর।’’
কার্যত এখান থেকেই উদ্যোগে শুরু। ক্রমে পুরো বিষয়টি নিয়ে উৎসাহ দেখান দলের অন্য সদস্য প্রহ্লাদ মণ্ডল, উমেশ পান, উৎপল মণ্ডলেরা। কৃষি দফতরের পরামর্শ মেনে পলিথিন শেড তৈরি করে বীজতলা তৈরি করা হয়। যাতে নিয়ন্ত্রিত আলো পায় এবং অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় বীজতলা। এমন উদ্যোগে জড়িয়ে খয়রাশোলের সহকৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলছেন, ‘‘মহকুমা কৃষি আধিকারিকের কাছে শুনেছিলাম কৃষি বিপণনের সুফল বাংলা এখানে একটি খরিফ পেঁয়াজের একটি প্রদর্শন ক্ষেত্র করতে চায়। সজল মণ্ডলেরা যখন পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ নিয়ে আমাদর কাছে এলেন, দু’পক্ষের যোগাযোগ হল। আমি নিশ্চিত ওঁরা সফল হলে পেঁয়াজ চাষে জেলায় আগ্রহ বাড়বে। বাজারমুখি চাষে, বিজ্ঞান মনস্ক চাষে তরুণরা এগিয়ে এলে কৃষির নতুন দিক খুলে যাবে।’’
একই দাবি সিউড়ি সদর মহকুমার সহ কৃষি আধিকর্তা(প্রশাসন) শিবনাথ ঘোষেরও। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে যখন কৃষি বিপণনের সুফল বাংলা প্রকল্পের আওতায় এমন প্রস্তাব আসে তখন একটা কথা মাথায় ছিল। বর্ষাকালে খয়রাশোল ও দুবরাজপুর-সহ ৮-১০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদী পড়ে থাকে। এখানে সহজেই বর্ষার পেঁয়াজ চাষ সম্ভব। ‘এগ্রিফাউন্ড ডার্ক রেড’ নামে একটি পেঁয়াজের জাত ওখানে লাগানো হয়েছে। যে জাত তুলনায় অনেক বেশি জল সহ্য করতে পারে।’’
গৌতমবাবু বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পে সিঙ্গুরের চাষিদের উৎপাদিত সব্জি কলকাতায় আমাদের বিভিন্ন রিটেল কাউন্টারে বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে। যাতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল সঠিক দামে বিক্রি করতে পারেন এবং মধ্যসত্বভোগীদের এড়িয়ে কম দামে ক্রেতারাও সরাসরি সে সব কিনতে পারেন, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সেটাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy