অনন্ত: ট্রেনের অপেক্ষায় বাঁকুড়া স্টেশনে বসে যাত্রীরা। সোমবার। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
তিন স্টেশন মিলিয়ে অবরোধকারীর সংখ্যাটা মেরেকেটে দেড়শো। তার জন্য সোমবার সারা দিন চূড়ান্ত দুর্ভোগের শিকার হলেন কয়েক হাজার যাত্রী। চিকিৎসার জন্য আদ্রা থেকে কলকাতা পৌঁছতে পারলেন না ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। সময়ে অফিসে যেতে পারলেন না রাজ্য সরকারের পদস্থ কর্মী। পরীক্ষা দিতে যাওয়া হল না ছাত্রছাত্রীদের।
সোমবার, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির (জেডিপি) ডাকা ভারত বন্ধে তিন স্টেশনে রেল অবরোধের জেরে পুরো আদ্রা ডিভিশনে ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়েছে। রেল সূত্রের খবর, সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা ওই অবরোধের জেরে বাতিল হয়েছে একটি এক্সপ্রেস-সহ ১৪টি ট্রেন। যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে ৮টি ট্রেনের। যাত্রাপথ বদল করতে হয়েছে ভুবনেশ্বর-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস-সহ ৪টি ট্রেনের।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘণ্টা সাতেক ডিভিশনের বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়েছিল ১৫টি ট্রেনকে। আদ্রা ডিভিশনের রেলের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘মধুকুণ্ডা, ইন্দ্রবিল ও কাঁটাডি স্টেশনে রেল অবরোধের জেরে ট্রেন চলাচল প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়েছে। রাজধানী এক্সপ্রেসটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমরা অবরোধকারীদের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু ওঁরা রাজি হননি।’’ বাঁকুড়ার ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজধানী এক্সপ্রেস খড়গপুর-টাটা রুটে ঘুরিয় দেওয়া হয় শেষে। আদ্রা থেকে যাঁদের রাজধানীতে ওঠার কথা ছিল, বিশেষ ট্রেনে তাঁদের বোকারো পোঁছে দেওয়া হয়।
ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-র রাজ্য সরকার গত বছর ভূমি অধিগ্রহণ আইন ও ধর্মান্তকরণ আইন এনেছে। আইন দু’টি প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছিল জেডিপি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযান। তবে বন্ধের ব্যাপারে কার্যত কোনও প্রচারই হয়নি জেলায়। ফলে অন্য দিনের মতোই এ দিন বেরিয়েছিলেন সবাই। তার পরেই শুরু ভোগান্তি।
এ দিন ভোর ৬টা থেকে আদ্রা-আসানসোল শাখার মধুকুণ্ডা, আদ্রা-মেদিনীপুর শাখার ইন্দ্রবিল, আদ্রা-চান্ডিল শাখার কাঁটাডি স্টেশনে অবরোধ শুরু করেন জেডিপি-র কর্মী সমর্থকেরা। তির-ধনুক, ধামসা, মাদল নিয়ে রেল লাইনের উপরে বসে পড়েন তাঁরা। তবে তাঁদের সংখ্যাটা বেশি ছিল না। রেল সূত্রের খবর, মধুকুণ্ডায় একশোর মতো অবরোধকারী ছিলেন। অন্য দু’টি স্টেশন মিলিয়ে অবরোধকারীদের সংখ্যাটা জনা সত্তর। তাঁরা ভোর ৬টা থেকে থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত, ৮ ঘণ্টা আদ্রা ডিভিশনে ট্রেন চলাচল স্তব্ধ করে দেন।
কেমন ভোগান্তি হয়েছে যাত্রীদের?
চিকিৎসার জন্য সোমবার দুপুরের মধ্যেই কলকাতায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে হত কাশীপুরের বাসিন্দা মধু মাহাতোকে। সকালে পুরুলিয়া-হাওড়া এক্সপ্রেস ধরতে স্টেশনে এসেছিলেন। পৌঁছে শোনেন, ইন্দ্রবিল স্টেশনে অবরোধ হচ্ছে। ট্রেন আটকে। কখন ছাড়বে তা-ও বলতে পারছেন না কেউ। অন্য ট্রেনে আসানসোল হয়ে কলকাতা যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সেই উপায়ও বন্ধ! আসানসোল শাখার মধুকুণ্ডা স্টেশনেও অবরোধ হচ্ছে। আদ্রা থেকে আসানসোল যাওয়ার ট্রেন পেলেন না তিনি। মধুবাবু বলেন, ‘‘কয়েক মাস ধরে কলকাতায় চিকিৎসা চলছে। কিছু পরীক্ষার জন্য যাওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু পারলাম না।’’
ট্রেন না পেয়ে সময়ে বাঁকুড়ায় পৌঁছাতে পারেননি মৎস্য দফতরের বাঁকুড়ার আধিকারিক দুর্গাদাস ঘটক। রঘুনাথপুরে বাসিন্দা দুর্গাদাসবাবু রোজ ট্রেনে অফিসে যান। সোমবার দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ট্রেনের ভরসা ছেড়ে গাড়ি ধরে কাশীপুর গিয়েছেন। সেখান থেকে বাস ধরে পৌঁছেছেন বাঁকুড়ায়। ততক্ষণে দুপুর। দুর্গাদাসবাবু বলেন, ‘‘বিভিন্ন কাজে দূর থেকে এসে অনেকে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের কাজটাও হল না।’’
স্কুলে পরীক্ষা ছিল সাঁতুড়ির রামচন্দ্রপুরের বাসিন্দা রাজশেখর চক্রবর্তীর ছেলে রুদ্রনীলের। রুদ্রনীল মধুকুণ্ডার একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। রোজ ট্রেনে স্কুলে যায়। এ দিন উপায়ান্তর না দেখে গাড়ি করে ছেলেকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন রাজশেখরবাবু। বলেন, ‘‘মধুকুণ্ডার কাছে বালিতোড়ায় পৌঁছে দেখি সেখানে রাস্তা অবরোধ করেছেন আদিবাসী সংগঠনের লোকজন। ছেলেটার পরীক্ষা দেওয়াই হল না।’’
এগুলি উদাহরণ মাত্র। সোমবার দিনভর এ রকম নানা ভোগান্তির ছবি দেখা গিয়েছে বিভিন্ন স্টেশনে। সকাল থেকেই ডিভিশনের তিন স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলেন রেলের আধিকারিক ও আরপিএফ-এর কর্মীরা। তাঁরা কেন অবরোধ তুলতে পারলেন না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন যাত্রীদের একাংশ। রেলের কর্তাদের দাবি, অনেকবার অবরোধ তোলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি।
এ রাজ্যে রেল অবরোধ করে ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকারের উপরে কী ভাবে চাপ তৈরি সম্ভব, অবরোধকারীদের উদ্দেশে সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। জেডিপির রাজ্য সভানেত্রী পানমণি বেশরা বলেন, ‘‘ঝাড়খন্ডের রাজ্য সরকারের আনা ভূমি অধিগ্রহন ও ধর্মান্তকরণ আইনে আদিবাসীদের চূড়ান্ত সর্বনাশ হবে। আইন প্রত্যহারের জন্য রাস্তায় নামা ছাড়া কোনও পথ খোলা ছিল না।’’ সাধারণ যাত্রীদের অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy