Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে সাইকেল নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির যুবক

ছেলে ঠিকই বলেছিল, এখন মানছেন বাবা

চোখের সামনে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে দিদিদের। সে তখন কিশোর। ছোট ছেলের কথা বলে কেউ আমলই দেয়নি তাকে। তবে কাজটা যে ঠিক হচ্ছে না, সেই বিশ্বাস আরও জাঁকিয়ে বসেছিল ছেলেটির মনে।

প্রত্যয়ী: বাঘমুণ্ডির বুড়দা গ্রামের অক্ষয় ভগৎ। নিজস্ব চিত্র

প্রত্যয়ী: বাঘমুণ্ডির বুড়দা গ্রামের অক্ষয় ভগৎ। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
ঝালদা শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:১৮
Share: Save:

চোখের সামনে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে দিদিদের। সে তখন কিশোর। ছোট ছেলের কথা বলে কেউ আমলই দেয়নি তাকে। তবে কাজটা যে ঠিক হচ্ছে না, সেই বিশ্বাস আরও জাঁকিয়ে বসেছিল ছেলেটির মনে। পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি ব্লকের বুড়দা গ্রামের সেই ছোট্ট অক্ষয় ভগৎ এখন তরতাজা তরুণ। বয়স ২৩ বছর। নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার জন্য সাইকেল নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন সারা দেশ। অক্ষয়ের বাবা বলছেন, ‘‘বাবা হয়েও আজ ছেলের কাছে আমাকে শিক্ষা নিতে হচ্ছে। সে দিন ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। সেটা যে কত বড়ো ভুল ছিল, আজ ও দেখিয়ে দিল।’’

শনিবার, প্রজাতন্ত্র দিবসে কর্ণাটকের সাইকেল উৎসবে শামিল হয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাওয়া হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি। ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চলন্ত লাইন করে তাঁরা ভারতের নাম তুলেছেন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। রাজ্য থেকে সেই দলে ছিলেন পুরুলিয়ার অক্ষয়। তবে তার আগে অনেকটা পথ চলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন গত মার্চে। সঙ্গে হাজার দুয়েক টাকা। একটি স্মার্ট ফোন। ভারতের একটি মানচিত্র। আর সাইকেল।

অভাবের সংসার অক্ষয়দের। দুই দিদি। দুই বোন। বাবা ভুবনেশ্বরবাবুর পেশা খবরের কাগজ আর দুধ বিক্রি করা। মাধ্যমিকের পরে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছিল অক্ষয়কে। বাবার সঙ্গে খবরের কাগজ ফেরি করেছেন। ঝালমুড়ি বিক্রি করেছেন। তার পরে এক দিন বাবা, মা আর দুই বোনকে ঘরে রেখে লহরিয়া শিবমন্দিরের সামনে থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

ঝাড়খণ্ডের রাঁচী। বিহার। উত্তরপ্রদেশ। মধ্যপ্রদেশ। দিল্লি। হরিয়ানা। গুজরাট। রাজস্থান। রেখা কালিন্দী, আফসানা খাতুনের জেলার এই ছেলের সাইকেলের চাকার নীচ দিয়ে সরে সরে গিয়েছে একের পরে এক জনপদ। এখন থেমেছেন কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে। সোমবার সেখান থেকে ফোনে বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত সতেরোটা রাজ্য ঘুরেছি। যত দিনই লাগুক না, পুরো দেশে প্রচার না করে ঘরে ফিরব না।’’

প্রায় এগারো মাস টানা সাইকেলে। বিভুঁইয়ে কখনও সমস্যায় পড়তে হয়নি? অক্ষয় বলেন, ‘‘হয়েছিল বটে একবার। মধ্যপ্রদেশের একটা জঙ্গলের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।’’ তবে ভাষা সংক্রান্ত টুকিটাকি মুশকিল ছাড়া আর বিশেষ কোনও সমস্যা হয়নি বলেই ডাকাবুকো তরুণ জানাচ্ছেন। জানাচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী তাঁকে দিয়েছেন গিয়ার দেওয়া সাইকেল। মিলেছে আরও তারিফ। আরও পুরস্কার। কিন্তু খেদটা এখনও থেকে গিয়েছে— দিদিদের বিয়ে হয়ে গেল নাবালিকা অবস্থাতেই।

ফোনে অক্ষয়ের বাবা ভুবনেশ্বর ভগতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘‘ছেলের জন্য আজ আমার গর্ব হয়। ও স্বপ্ন সফল করে ফিরুক।’’ তিনি দাবি করছেন, অভাবের তাড়না এমন ছিল, কার্যত বাধ্য হয়েই বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হয়েছিল। তার পরের মেয়েটিরও বিয়ে দিয়েছেন সাবালিকা হওয়ার আগে। সব থেকে ছোট মেয়েটি এখন পড়শোনা করছে। কন্যাশ্রীর টাকা পায়। ২০২০ সালে মাধ্যমিকে বসার কথা তার। ভুবনেশ্বরবাবু বলেন, ‘‘ছোট মেয়েটাকে পড়াব। বড় করে তুলব। ছেলেটা যে এত কষ্ট করছে, সেটাকে তো অপমান করতে পারি না।’’

পুরুলিয়ার জেলাশাসক অলেকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘যাত্রা শুরুর সময়ে ওঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। সেই ছেলে এত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, শুনেও ভাল লাগছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Minor Marriage Cycle Young Man
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE