ডাক হরকরা। ছবি: সুজিত মাহাতো।
রানার চলেছে, রানার...
অযোধ্যা পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙে। ক্লান্তি এলেও চিঠির বোঝা নামিয়ে গাছের ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার জো নেই। জঙ্গলের বাঁকে বাঁকে সাইকেলের ঘণ্টি বেজে চলেছে।
তিনি শান্তবালা মাহাতো। পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত ব্লক বাঘমুণ্ডির ঘোড়াবান্ধা-সিন্দরি শাখা ডাকঘরের রানার তিনি। স্রেফ মনের জোরে টানা ১৮ বছর ধরে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা গাঁয়ের পর গাঁ উজিয়ে তিনি সাইকেলে ডাক নিয়ে যাচ্ছেন।
সিন্দরি গ্রামে শান্তবালার সংসার তিন মেয়েকে নিয়ে। স্বামী রানারের কাজ করতেন। ১৯৯৫ সালে হঠাৎই মারা যান তিনি। ছিঁটেফোঁটা জমি নিয়ে তিন মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে অন্ধকার দেখেন শান্তবালা।
কী করবেন? মৃতের পোষ্য হিসেবে স্বামীর কাজ চেয়ে আবেদন করবেন? পারবেন ১৬ কিলোমিটার পথ চিঠি নিয়ে যাতায়াত করতে?
স্বামী হারানোর শোক ছাপিয়ে প্রশ্নগুলো তোলপাড় করে শান্তবালার মনে। তাঁর কথায়, “সারা বছর ধরে দুর্গম রাস্তায় চিঠি নিয়ে যাওয়া কম দায়িত্বের কাজ নয়। পারব কি না, নিজেরই সন্দেহ ছিল। আত্মীদেরও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে তিনটের মুখের দিকে তাকিয়ে কাজটা নিয়ে নিই।”
সেই শুরু। সাতসকালে উঠে গোয়ালে গরু-বাছুরকে জাবনা দেওয়া, রান্না করা, ঘুঁটে দেওয়া থেকে মাঝে-মধ্যে সামান্য জমিতে চাষের কাজও তাঁকেই করতে হত। সব গুছিয়ে সকাল ১০টার আগে ছুটতেন এক কিলোমিটার দূরে ঘোড়াবান্ধা-সিন্দরি শাখা ডাকঘরে। চিঠি গুছিয়ে ব্যাগে ভরে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা বাসে সাত কিলোমিটার দূরে বাঘমুণ্ডি ডাকঘর। বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যেত।
এখনও শান্তবালার মনে পড়ে, “তখন রাস্তাঘাট অনেক ফাঁকা ছিল। গ্রামের মেয়েদের রাস্তায় খুব একটা দেখা যেত না। নানা রকম ভয় তো ছিলই। তিন মেয়েকে বাড়িতে রেখে আসতাম। ওদের দিকেই মন পড়ে থাকত।” পরে প্রয়োজনের তাগিদেই সাইকেল চালানো শিখে নিয়েছেন। এখন সাইকেলেই যাতায়াত করেন। মেয়েরাও লেখাপড়া শিখে বড় হয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে পরীবালা এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। সে-ও ঘরের কাজে দিদিদের মতো মাকে অল্পবিস্তর সাহায্য করে।
সপ্তাহে ছ’দিন একই রুটিন। বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। শরীর সায় দেয়?
বাঘমুণ্ডি ডাকঘরের দাওয়ায় বসে শান্তবালা বলেন, “ডাকের ব্যাগে কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে। কারও চাকরির নিয়োগপত্র তো কোনও বাড়ির মানি অর্ডারের টাকা। হাঁফিয়ে পড়লে চলবে?” কোনও দিন অসুস্থ হয়ে পড়লে? পাশ থেকে কুশলডির রানার রাজেন গরাই বলেন, “শান্তদি যে দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর ছোট মেয়ে চিঠি নিয়ে আসে। তবে খুব কাহিল হয়ে না পড়লে দিদি কামাই করেন না।” পোস্টমাস্টার বিভূতিভূষণ রাজোয়াড় বলেন, “অনেকদিন ধরেই শান্তদেবীকে দেখছি। উনি ক্লান্তিহীন। রোদ-বৃষ্টি মাথায় হাসিমুখেই কাজ করেন। কখনও অভিযোগ শুনিনি।” ডাকঘরের কর্মী ইসরার আরা বলেন, “দিদিই আমাদের প্রেরণা।”
বাঘমুণ্ডিতে ব্যাগ জমা দিয়ে ফের সাইকেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে সিন্দরির পথে বেরিয়ে পড়েন শান্তবালা। পথে আনন্দনগর, হিকিমডি, চড়িদার মতো ছোট-ছোট গ্রাম। চাকার নীচে এবড়ো-খেবড়ো পথ। সাইকেলের ঘণ্টি বেজে চলে ক্রিং ক্রিং ক্রিং...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy