Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নাট্য উৎসব বন্ধ, হতাশ শহরের শিল্পীরা

শিল্প, সাহিত্য আর নাট্যচর্চার দিক থেকে রাজ্যের অন্য জেলা শহরের মধ্যে একসময় অন্যতম ছিল বোলপুর শান্তিনিকেতন। কিন্তু কখনও বোলপুর এলাকায় তেমন প্রভাব ফেলেনি রবীন্দ্র-ঘরানার নাটক। এলাকার নাট্যচর্চার ইতিহাস বলছে, বোলপুরের ‘সখের নাট্যচর্চা’ অন্য শহরের মতো এখানেও হেঁটেছে গণনাট্যের পথে। একসময় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে এ শহরে। কিন্তু ইদানীং সেই উদ্যোগ উধাও!

কিণাঙ্ক গোষ্ঠীর ‘অন্ধকার থেকে’ নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র

কিণাঙ্ক গোষ্ঠীর ‘অন্ধকার থেকে’ নাটকের একটি দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র

মহেন্দ্র জেনা
বোলপুর শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:২৭
Share: Save:

শিল্প, সাহিত্য আর নাট্যচর্চার দিক থেকে রাজ্যের অন্য জেলা শহরের মধ্যে একসময় অন্যতম ছিল বোলপুর শান্তিনিকেতন। কিন্তু কখনও বোলপুর এলাকায় তেমন প্রভাব ফেলেনি রবীন্দ্র-ঘরানার নাটক। এলাকার নাট্যচর্চার ইতিহাস বলছে, বোলপুরের ‘সখের নাট্যচর্চা’ অন্য শহরের মতো এখানেও হেঁটেছে গণনাট্যের পথে। একসময় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে এ শহরে। কিন্তু ইদানীং সেই উদ্যোগ উধাও!

শহরে কেন তেমন নাট্যচর্চা নেই, কেন মুখ ফিরিয়ে বর্তমান প্রজন্ম?

এলাকার সংস্কৃতির চর্চাকারীদের এক কথায় উত্তর, ‘রাজনীতি’। বিশদে তাঁরা বলছেন, সংস্কৃতি চর্চার ভিতর এমনভাবে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ শহরে, যে নাট্যচর্চার পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে পড়ছে। নাট্য সংস্থাগুলির মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় এবং বোঝাপড়ার অভাবও দেখা দিয়েছে। রয়েছে সরকারের উদাসীনতা। প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় ও আর্থিক অনটনেও কার্যত নাট্য সংস্থাগুলির ধুঁকতে বসেছে।

বিশ্বভারতীর ড্রামা অ্যান্ড থিয়েটার আর্টস বিভাগের অতিথি অধ্যাপক সলিল সরকার অবশ্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বহির্ভূত সরকারী পৃষ্টপোষকতায় যে নাটক বা শিল্প প্রযোজনা হয়, তার সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, “সাড়া পৃথিবীর নাট্য আন্দোলন সেই দেশ, সেই দেশ কালের রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন ছাড়া গড়ে ওঠেনি।” তাঁর দাবি, “বর্তমান কালকে স্মরণ করে, এই সময় যে সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে তা নতুন কোনও নাট্য আন্দোলন সৃষ্টিরই পূর্বাভাষ।”

বোলপুর শহরে নাট্যচর্চার ইতিহাস বহুকালের। পাঁচের দশকের শুরুতে নাট্যচর্চার শুরু বোলপুরে। তখন শ্রী নাট্যম (১৯৫৯-৬০) সংস্থার সঙ্গে মঙ্গল চৌধুরী, কুশল চৌধুরী, ক্ষুদিরাম সেন, জগদীশ মণ্ডল, অমিয় ভট্টাচার্য, রেনুপদ দে, বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়রা যুক্ত ছিলেন। পরে বদরে আলমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ভার্ডেন্ট থিয়েটার গ্রুপ। তাঁদের প্রথম নাটক মহেশ। এই সংস্থার বেশ কিছু পুরষ্কার পাওয়ার নজির রয়েছে। এর পর থেকে গুটি গুটি পায়ে পথ চলা শুরু বোলপুরের নাট্যচর্চার।

বহু বাধা বিপত্তি পার হয়ে, ১৯৭২ সালে পার্থসারথী ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সুবোধ নায়েক, অশোক মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ কবিরাজ, অসিতা রঞ্জন চৌধুরী, ব্রজ গোপাল সাধুরা গড়ে তোলেন ‘নাট্য সারথী’। পরবর্তী সময়ে ওই নাট্যসংস্থার হাল ধরেন অমিয় চট্টরাজ। তাঁদের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে, পাগল পৃথিবী পাগল, দুরন্ত দুর্যোগ, হরিপদর শীতবস্ত্র, তাহার নামটি রঞ্জনা, ঘাটবস্ত্র। প্রদীপ কবিরাজের নেতৃত্বে পাঞ্চজন্য সংস্থাও কিছু প্রযোজনা করে। কী বলছে এই নাট্যগোষ্ঠী?

প্রদীপবাবু বলেন, “নাটক নিয়ে আগ্রহ নেই নতুন প্রজন্মের। তিন বছর আগে নাট্য উৎসবে দর্শক আসন খালি পড়ে থাকতে দেখে সেই কথাই মনে হয়েছে। তবে, সরকার পাশে দাঁড়ালে হয়তো এমনটা হত না।”

১৯৮০ সালে বোলপুরের ধর্ম রাজতলায় গোরাচাঁদ সেনগুপ্তের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ পায় নাট্য সংস্থা ‘হোমানল’। তাঁদের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা গলগ্রহ, বহুরূপী, ময়রা মতির তীরে, আলোর ইশারা পেয়ে, ধর্মঘট, স্বীকার, অচল সংসার, রঞ্জনার সলিল সমাধি। বহুরূপী প্রযোজনার জন্য ২০০৩ সালে এই নাট্য সংস্থা রাজ্য সরকারের পুরষ্কার পায়। নাট্যদলের ঝুলিতে রয়েছে ভারত সরকার আয়োজিত পটনায় নাট্য উৎসবে তৃতীয় পুরষ্কারও। ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে গোরাবাবু বলেন, “শহরে নেই কোনও স্থায়ী মঞ্চ। নেই সরকারের আর্থিক সহায়তা। নাট্যচর্চা এখন দিবা স্বপ্ন এ শহরে!”

‘সরকার পাশে থাকলে এমন হত না’, বলছেন নাট্য দলগুলির কোনও কোনও কর্তা ব্যক্তিরা। ঘটনা হল, তিন বছর আগে যে নাট্য উৎসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাতে তেমন দর্শক হত না ঠিকই, কিন্তু কিছু মানুষও নাটক দেখতে যেতেন। উৎসাহ পেত নাট্যদলগুলিও। কিন্তু সেই নাট্য উৎসব এখন বন্ধ। সে কথাই বলছিলেন ‘উত্তরণ’ নাট্যদলের কামদেব গোস্বামী।

বোলপুর গণনাট্য দল ‘উত্তরণ’-এর প্রতিষ্ঠা ১৯৮১ সালে। ‘উত্তরণ’-এর প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে, মহেশ, চানাপড়া, মানুষ, কাঁচারোদ, হারানের নাতজামাই, হায় রাম, জিয়ন কন্যা, উত্তর সারথী, পুনরুত্থান, জানগুরু, জ্বালার মতো বেশ কিছু নাটক। সংস্থার পক্ষে কামদেববাবু বলেন, “গত তিন বছর ধরে এলাকায় নাট্য উৎসব বন্ধ রয়েছে। নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।”

লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের সভাপতি থাকাকালীন ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নাট্য উৎসব হয়েছে। এলাকার সাংসদ হওয়ার সুবাদে পর্ষদের সভাপতি হন রামচন্দ্র ডোম। তাঁর মেয়াদের দু’বছরও নাট্য উৎসব হয়েছে। সেই উৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সোমনাথবাবু বলেন, “সাংস্কৃতিক চর্চার জন্যই গীতাঞ্জলির পরিকল্পনা করা হয়। সেই সময়ে শহরে রবীন্দ্রসদন বা রবীন্দ্রভবনের মতো কোনও সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল না। তাই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা, প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে এমন একটি অঙ্গনের। উৎসব বন্ধ হওয়া উচিত নয়, বর্তমান যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের ব্যবস্থা করা উচিত।”

কলকাতা তথা সারা রাজ্যের নাট্যচর্চার সঙ্গে পাল্লা দেওয়াতে বোলপুরের কিণাঙ্ক নাট্যগোষ্ঠীর নাম সুবিদিত। ১৯৯৩ সালে আত্মপ্রকাশ এই গোষ্ঠীর। নিচুপট্টীর শুভব্রত রায়চৌধুরীর হাত ধরে কিণাঙ্ক-র প্রযোজনা অন্ধকার থেকে, বনসী বাইগার অভিষেক, ওঝার ঘাড়ে ভূত, মন মন্দির, নীল দর্পণ এবং, সন্ন্যাসী। শ্রুতি নাটক হিসেবে তাঁদের প্রথম নিবেদন, রিক্তাকে নিয়ে চিঠি। এছাড়া তাহার নামটি রঞ্জনা, প্রথম পার্থ ও রবিবারের মতো প্রযোজনাগুলিও রাজ্যের নানা গ্রুপ থিয়েটার উৎসবে চর্চিত। শহরের নাট্যচর্চা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শুভব্রত বলেন, “বোলপুরে তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায় এক সময়ে নাট্য চর্চাকে উৎসাহ দিত। সে সময় অভিভাবকেরাও আজকের মতো ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় পড়ুয়াদের শামিল করত না। তাই নাট্য চর্চার পরিসর বাড়ছিল। পরিবেশও উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু এখন সময়টাই আলাদা। বিকল্প থিয়েটারের দিকে ঝোঁক বাড়ছে।”

কেউ কেউ বলতে চান নানা সমস্যার সঙ্গে ইদানীং শহরের নাট্যচর্চায় যুক্ত হয়েছে ‘অযোগ্য কিছু দলের দাপাদাপি’। তেমনই একজন বোলপুরের নতুনপুকুর কালীতলা এলাকার মলয় ঘোষ। তাঁর হাত ধরে ২০০২ সালে জন্ম নিয়েছে ইলোরা নাট্য সংস্থা। উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হৃদয়পুর কত দূর, পাশ ফেল, বিদ্যা বোঝাই বাবু, শেষ বিচারের আশায়, মানব জমিন। মলয়বাবু বলেন, “সাড়া বছর কোনও ধারাবাহিকতা থাকে না। অথচ নাট্য মেলায় গুলিতে অনায়াসে সুযোগ নেয় কিছু দল। শহরে নাট্যচর্চায় নানা সমস্যার সঙ্গে এটিও বড় সমস্যা একটি। কেন না, সাড়া বছর ধরে যাঁরা এই শিল্প নিয়ে চর্চা করে থাকেন তাঁদের মঞ্চ পাওয়ার সুযোগই থাকছে না।”

জামবুনিতে ২০০৩ সালে জুলফিকার জিন্নার হাত ধরে তৈরি হয় আমরা সবুজ নাট্য গোষ্ঠী। তাঁদের ইচ্ছে ডানার পাখি, ভীম বধ, গণ্ডগোল, কাল বা পরশু, শাড়ি, প্রস্তাব, রিরংসা, লাঠি, নগ্ন নগরের মতো প্রযোজনা গুলি সাড়া জাগিয়েছে। জুলফিকার মনে করেন, “শহরে নাট্যচর্চার পরিকাঠামো নেই, আর্থিক অভাবে নতুন প্রযোজনা করা দিন দিন মুশকিল হয়ে পড়ছে। দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাবেও পিছিয়ে পড়ছে বোলপুর।”

যে শ্রীনিকেতন শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের উদ্যোগে প্রায় ১০ বছর নাট্য উৎসব হয়েছে শহরে, কী ভাবছেন তাঁরা? পর্ষদের কার্যনির্বাহী আধিকারিক পুলক সরকার বলেন, “বোর্ড মিটিং-এ আলোচনা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী বৈঠকে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE