ব্রহ্মদৈত্যতলা। ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।
এলাকায় সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক কৃষ্টি ধরে রাখতে সেই কবে থেকে যে, পাড়ুইয়ে ব্রহ্মদৈত্যের মেলা বসছে তার দিনক্ষণ সঠিক করে বলা খুব মুশকিল। কিন্তু নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে পরস্পরের উত্তম বোঝাপড়া ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে আজও জেলায় জনপ্রিয় প্রাচীন এই মেলা।
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, পয়লা মাঘ ব্রহ্মদৈত্য তলায় রীতি মেনে পূজার্চনা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুজো শেষে, ওই এলাকায় তিন দিনের মেলা বসে। সেই মেলাকে ঘিরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর বাইরে আরও এলাকা মাতে দুর্গাপূজার নবমীতে বাঁধের মা কালীর পুজোয়। তবে, ব্রহ্মদৈত্যের মেলা এবং তিন দিনের এই উত্সবকে ঘিরে পাড়ুই এলাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় পরিজনদের আনাগোনা হয়। এক অর্থে তাই এ মেলা এলাকার পুনর্মিলনও উত্সবও।
পাড়ুই ব্রহ্মদৈত্যের মেলাকে নিয়ে একসময় প্রচলিত ছিল একটি ছড়া, ‘পাড়ুইয়ের মেলা, হাঁড়ি আর হোলা’। কেন না, মাটির হাঁড়ি, থালা-বাসন হরেকরকমের মাটির জিনিষ পাওয়া যেত একসময়। জাযগার অভাবে, একসময় মেলার জায়গা স্থানান্তর হয়। বোলপুর-সিউড়ি মুখ্য রাস্তার ধারে কুড়ির মাঠে কয়েক দশক ধরে মেলা আয়োজনের পর, বছর তিনেক হল মেলার স্থানান্তর হয়েছে পাড়ুই থানা সংলগ্ন মাঠে।
মেলা উপলক্ষে আয়োজিত নাটকের জন্য পুরুষ-মহিলা কয়েক মাস আগে থেকেই রিহার্সাল দেন। সে সব প্রসঙ্গ তুলে মেলার সম্প্রতির কথা বলছিলেন সদগোপ পাড়ার বাসিন্দা তপন ঘোষ। পাড়ুই বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকার ব্রহ্মদৈত্য তলার দিকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “সেই কবে থেকে এই মেলা বসছে, তার কোনও লিখিত ইতিহাস নেই। সব ধর্মের মানুষ মেলায় মেতে ওঠে।”
জনশ্রুতি, সেকমপুর এলাকার এক মুসলিম ভদ্রলোক পেশায় তিনি তহসিলদার ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর, ব্রহ্মদৈত্যের মেলায় এসে রোগমুক্তি ঘটে তাঁর। সেই থেকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে, এই পুজো এবং মেলাকে ঘিরে মানুষের নানা চাওয়া-পাওয়া গড়ে উঠেছে। সেই কারণেই গড়গড়িয়ার ব্রহ্মদৈত্যের পুজোর পর পাড়ুই ব্রহ্মদৈত্যের মেলায় শরিক হন ওই গ্রামের মানুষ।
পাড়ুই থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে গড়গড়িয়া গ্রামেও পয়লা মাঘ ব্রহ্মদৈত্যের পুজো হয়। তাকে ঘিরেও তিন দিনের মেলা বসত। গড়গড়িয়ার পাশে ইমাদপুর, সেকমপুরের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামের মানুষজন শরিক হতেন ওই মেলায়। এলাকার হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান সমাদৃত এই মেলাকে ঘিরে সম্প্রীতির কথা শোনালেন পাড়ুই জুনিয়র বেসিক স্কুলের শিক্ষক শফিউল্লা শাহ। তিনি বলেন, “হিন্দু ও মুসলমান সমান ভাবে মিলিত হয়ে এখন মেলা চালালেও, ১৯৯০ সালে এই মেলা কমিটির সকলে ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। বহুকাল আগে, একসময় গড়গড়িয়ার ভট্টাচার্যদের হাত ধরে ওখানে ব্রহ্মদৈত্যের পূজা-আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল। ১৮২০ নাগাদ পাড়ুইতে স্থানীয় বৈদ্যনাথ ঘোষ ব্রহ্মদৈত্যকে স্থাপন করেন জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে। সেই তখন থেকেই সম্প্রীতির এই অনন্য নজির বয়ে চলেছে এখানকার তিন দিনের মেলা।”
ওই গ্রামের অশীতিপর শিক্ষক গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়, বাসুদেব মুখোপাধ্যায়রা বলেন, “তিন দিনের মেলাকে ঘিরে এলাকায় এলাহি ব্যাপার চলে। একসময় আশেপাশের সাহিত্য, সংস্কৃতির এক রকমের মেল বন্ধনের জায়গা ছিল। ‘লেটোগান’ প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা করে খ্যাতি ছিল।”
শুধু ব্রহ্মদৈত্যের পুজো বা মেলাকে ঘিরে নয়, কথিত আছে পাড়ুইয়ের বাঁধের মাকে নিয়ে এলাকার সকলের মনে গেঁথে রয়েছে নানা বিশ্বাস। রাখহরি মুখোপাধ্যায় পুরুষানুক্রমিক সেবাইত। তিনি বলেন, “দাদু রাধাপদ মুখোপাধ্যায় এবং বাবা ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়দের কাছে শুনেছি, বাঁধের মা খুব জাগ্রত। মন্দিরে ডাকাতি করতে এসে সাত ডাকাতের দৃষ্টিহীন হওয়া এবং সকালে দেবীর কৃপায় ফের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনি আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy