চণ্ডীদাসের ঢিবি। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
সেই হাতিও নেই, সেই ঘোড়াও নেই। দেউড়ি বাড়িতে বসে না আর বিচারসভা!
কিন্তু কীর্ণাহারবাসীদের মুখে এখনও ঘুরে ফিরে আসে হাতিশালা, ঘোড়াশালা, দেউড়িবাড়ির কথা। আসলে কীর্ণাহার একসময় ছিল দু’জন রাজা এবং দু’জন জমিদারের শাসনে। তাঁদেরই নানা কীর্তি কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে কীর্ণাহারের আনাচে কানাচে। রয়েছে নাম নিয়েও নানা লোকশ্রুতি!
ইতিহাস বলে, কীর্ণাহার একসময় স্থানীয় মতিপুর, অধুনা লাভপুরের কুরুন্নাহার, মুর্শিদাবাদের কুরন্নরুন-সহ লাগোয়া বর্ধমান জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সে সময় ওই জনপদের রাজা ছিলেন কিঙ্কিন। কিঙ্কিনকে হত্যা করে পরবর্তী কালে রাজা হন কিলগির খাঁ নামে একজন পাঠান সৈনিক। কথিত আছে, রাজা কিঙ্কিনের মৃত্যুর পর রানী দুর্গাবতী কীর্ণাহারের অদুরে মহেশপুর স্টেশন লাগোয়া স্থানে আশ্রয় নেন। ওই স্থানটি তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রানীপাড়া হিসাবেও পরিচিত।
সেই দুই রাজার নামানুসারেই নাকি জনপদটির নাম কীর্ণাহার হয়েছিল। কেউ বলেন, নাহার অর্থা প্রাকৃতিক খাতের তীরে গড়ে ওঠেছিল প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ছোট বসতি ‘কুড়ি’, তাই ওই জনপদের প্রাথমিক নাম ছিল কুড়িনাহার। প্রবীণ বাসিন্দাদের দাবি, এলাকার সরকারি নথিতেও মৌজা বা গ্রাম হিসাবে কুড়িনাহারের উল্লেখ রয়েছে। ঘটনা হল, সেদিনের সেই কুড়িনাহারই ক্রমবির্বতনে আজকের কীর্ণাহার। আবার আহার অর্থাৎ শস্যে সমৃদ্ধ ছিল, তাই জনপদের নাম কীর্ণাহার হয়েছিল বলেও অনেকে মনে করেন। এমন জনশ্রুতিও প্রচলিত, কর্ণের নামানুসারে কর্ণহার, এবং কর্ণহার থেকেই কীর্ণাহারের উৎপত্তি।
নামে কী আসে যায়?
কীর্ণাহার মসগুল রাজা-জমিদারদের কথা ও কাহিনিতে। দক্ষিণ এবং মেলে পাড়ার সংযোগস্থলে দুটি জায়গা আজও ঘোড়াশালা এবং হাতিশালা হিসাবে পরিচিত। ওই স্থানদুটিকে দেখিয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা বলাবলি করেন, ওখানে হাতি বাঁধা থাকত, ওখানে ঘোড়া। হাওদা চড়ে রানীরা গঙ্গাস্নানে যেতেন। ঘোড়া ছুটিয়ে রাজা-জমিদারেরা যেতেন শিকারে। হাতিতে চড়ে জমিদারদের স্থানীয় পোষলা গ্রামে বাঘ মারার গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।
সরকার জমিদারদের হরিণ শিকারের কথাও প্রচলিত রয়েছে। শিকার করা সেই হরিণের চামড়ার আসনে বসেই নাকি আজও সরকার বাড়ির দুর্গা পুজো হয়। ওই জমিদার বাড়ির হাতিতে টানা রথের কথাও বংশ পরম্পরায় বাহিত হয়ে চলেছে। আজ হাতি নেই! কিন্তু সরকার বাড়ি প্রতিষ্ঠিত রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় সাড়ম্বরে।
দক্ষিণপাড়াতেই রয়েছে দেউড়িবাড়ি। একসময় সেখানে নিয়মিত বিচারসভা বসত। এখন সেই বাড়ি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। একাংশে স্থানীয় যুব সংঘের যাত্রার মহড়া হয়। কীর্ণাহারে মূলত দুই জমিদার বাড়ির উল্লেখ রয়েছে। সরকার এবং দাস পরিবার। এলাকায় দাতব্য চিকিৎসালয়, গ্রন্থাগার, বালিকা বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন-সহ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিকাশে জড়িয়ে রয়েছ সরকার পরিবারের প্রাণপুরুষ কিশোর সরকার, শিবচন্দ্র সরকার এবং তাঁর তিন পুত্র শৈবেশ, সত্যেশ এবং সৈরেশ সরকারের নাম। অন্যদিকে দাস পরিবারের আনুকুল্যে নির্মিত হয়েছিল একটি প্রাথমিক স্কুল এবং নাট্যমঞ্চ। স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা প্রয়াত কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের নামও জড়িয়ে রয়েছে এলাকার উন্নয়নে। তাঁরই প্রচেষ্টায় কীর্ণাহারে মহকুমা সেচ এবং পূর্ত সড়ক দফতর স্থাপিত হয়।
রাজা-জমিদারদের পাশাপাশি নাটোরের রানী ভবানী প্রতিষ্ঠিত পট-সহ ৬ টি দুর্গা এবং ৪ টি কালি পুজোও এলাকার প্রাচীনত্বের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রাচীনত্বের স্বাক্ষ্য বহন করছে প্রায় ৪০০ বছরের ভদ্রকালীর থানও। নানুরের মতোই চণ্ডীদাসকে ঘিরে আবেগপ্রবণ কীর্ণাহারও। তাঁদের মতে, একসময় রামীর সঙ্গে প্রণয় ঘটিত কারণে সমাজপতিদের রোষানলে পড়ে চণ্ডীদাস নানুর ছেড়ে আশ্রয় নেন কীর্ণাহারে। সেখানে তাঁর নামগানে আকৃষ্ট হয়ে প্রণয়াসক্ত হন পাঠান রাজ কিলগির খাঁ’র। মেয়ে তাতে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পাঠানরাজ চণ্ডীদাসকে জীবন্ত সমাধি দেন।
সেই জায়গাটি আজ চণ্ডীদাস পাট হিসাবে খ্যাত। সেখানেই নির্মিত হয়েছে চণ্ডীদাসের সমাধি মন্দিরও। পরবর্তী কালে ওই সমাধি মন্দিরের পাশেই নির্মিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের সুদৃশ্য মন্দিরও। পর্যটকরা ওই সমাধিক্ষেত্র দর্শনে আসেন। কিন্তু সরকারি উদ্যোগের অভাবে কবির পাঠভুমি অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।
সাংস্কৃতিক কর্মী তথা স্থানীয় স্কুল শিক্ষক অরুণ রায় বলেন, “নানুরের পাশাপাশি চণ্ডীদাসের সাধনক্ষেত্র হিসাবে সমান্তরালে বিবেচিত হয় কীর্ণাহারের নামও। কিন্তু চণ্ডীদাসের স্মৃতি রক্ষার্থে কীর্ণাহারে কোনও সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।” নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা বলেন, “বাসিন্দারা লিখিত আকারে কোনও পরিকল্পনার কথা জানালে, তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy