Advertisement
১৫ মে ২০২৪

বরফে চোখ ঝলসে লুটিয়ে পড়েন ক্লান্ত রাজীব

চরম ক্লান্তি আর মুহূর্তের অসাবধানতায় বরফ-ঢালে গড়িয়ে গিয়েছিলেন ছন্দা গায়েন। এভারেস্ট ছোঁয়া প্রথম বাঙালি মেয়ে ছন্দার ৩২ বছরের জীবনের অভিযান থমকে গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিমে ইয়ালুং কাং শৃঙ্গ ছুঁতে গিয়ে। ২০১৪ সালের ২০ মে। তাঁর সহ-অভিযাত্রী রাজীব ভট্টাচার্য বেসক্যাম্প থেকে দিয়েছিলেন দুঃসংবাদটা।

লোৎসে শৃঙ্গ অভিযানে রাজীব ভট্টাচার্য (ইনসেটে)। —ফাইল চিত্র।

লোৎসে শৃঙ্গ অভিযানে রাজীব ভট্টাচার্য (ইনসেটে)। —ফাইল চিত্র।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

চরম ক্লান্তি আর মুহূর্তের অসাবধানতায় বরফ-ঢালে গড়িয়ে গিয়েছিলেন ছন্দা গায়েন। এভারেস্ট ছোঁয়া প্রথম বাঙালি মেয়ে ছন্দার ৩২ বছরের জীবনের অভিযান থমকে গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিমে ইয়ালুং কাং শৃঙ্গ ছুঁতে গিয়ে। ২০১৪ সালের ২০ মে। তাঁর সহ-অভিযাত্রী রাজীব ভট্টাচার্য বেসক্যাম্প থেকে দিয়েছিলেন দুঃসংবাদটা।

ঠিক দু’বছরের মাথায় সেই রাজীব ভট্টাচার্যেরই খবর এল। একই ভাবে। ১৯ তারিখ সকালে ৮১৬৭ মিটার উঁচু ধৌলাগিরি অভিযানে শৃঙ্গ ছোঁয়ার পর, নেমে আসতে গিয়ে মারা গিয়েছেন ৪৩ বছরের রাজীব।

সেই ধৌলাগিরি, যেখানে মৃত্যুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফিরেছিলেন বাংলার প্রথম অসামরিক এভারেস্ট আরোহী বসন্ত সিংহরায়।

নেপালের পর্বতারোহী আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মিংমা শেরপা শুক্রবার সকালে ফোনে জানালেন, রাজীবের সঙ্গী তাশি শেরপা তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন বেসক্যাম্প থেকে। সেই তাশি শেরপা, যিনি ছন্দা গায়েনের দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী।

তাশি জানিয়েছেন, শৃঙ্গ ছোঁয়ার পরপরই রাজীবের চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়। পাহাড়ি পরিভাষায়, স্নো ব্লাইন্ডনেস (তুষার অন্ধত্ব)। সাধারণত বেশি উচ্চতায় বরফের গায়ে প্রতিফলিত সূর্যের আলো চোখে পড়ায় এই রোগে আক্রান্ত হন অভিযাত্রীরা। তাশির দাবি, অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ খুলেই রাখতে পারছিলেন না রাজীব। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর গতি অনেকটা কমে গিয়েছিল। সামিট করে নামার সময় চতুর্থ ক্যাম্প আর তৃতীয় ক্যাম্পের মাঝামাঝি প্রচণ্ড ক্লান্তিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর।

রাজীবের দেহ নীচে নামাতে পারেননি তাশি। জানিয়েছেন, প্রায় সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় একটি পাথরে রাজীবের দেহ বেঁধে রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচের ক্যাম্পে নেমে এসে মিংমাকে খবর দেন তিনি। শুক্রবার সারা দিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় হেলিকপ্টার পাঠিয়ে নামিয়ে আনা যায়নি রাজীবের দেহ।

দুর্ঘটনা নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। তা হলে ঠিক কী কারণে মারা গেলেন রাজীব?

এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ পাঁচটি আট-হাজারি শৃঙ্গ ছোঁয়া পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষ জানাচ্ছেন, যে কোনও বড় শৃঙ্গের ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত আরোহণটা খুব কঠিন হয়। আর তার চেয়েও বেশি কঠিন হয়, সুস্থ শরীরে নীচে নেমে আসা। পথের দূরত্ব এতই বেশি, অক্সিজেনে কুলিয়ে ওঠা মুশকিল। এক জন আরোহীর জন্য তিনটে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে যান তাঁর শেরপা। সঙ্গে থাকে তাঁর নিজের আরও দু’টি সিলিন্ডার। প্রতিটা চার কিলোগ্রাম ওজনের, অর্থাৎ মোট কুড়ি কিলোগ্রাম। এক-একটি

সিলিন্ডার খুব বেশি হলে ছ’ঘণ্টা চলে।

অর্থাৎ এক জন আরোহীর তিনটি সিলিন্ডারে চলে মোট আঠেরো ঘণ্টা। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই

সামিট ক্যাম্প থেকে শুরু করে শৃঙ্গ ছুঁয়ে নেমে আসার মোট সময় আঠেরো ঘণ্টার থেকে অনেকটাই বেশি হয়।

২০১১ সালে রাজীব ভট্টাচার্যের এভারেস্ট অভিযানের সঙ্গী ছিলেন দীপঙ্কর ঘোষ। তার পরে লোৎসে ও কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানেও একসঙ্গেই ছিলেন তাঁরা।

তা হলে কি অন্ধত্ব, ক্লান্তি আর অক্সিজেনের অভাবই রাজীবের মৃত্যুর কারণ?

বহু দিন ধরে পর্বতারোহীদের নানা রকম সমস্যার সমাধান করেছেন চিকিৎসক সুশান্ত ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘স্নো ব্লাইন্ড হয়ে যাওয়া মানে চোখের ভেতরে একটা পোড়া ক্ষত তৈরি হওয়া। তাতে শারীরিক ক্লান্তি এমনিতেই অনেকটা বেড়ে যায়। তার উপর চোখ প্রায় বন্ধ করে বরফ ঢালে নামা মোটেই সহজ নয়। মানসিক জোরও কমে যেতে বাধ্য। আর এতে সময় বেশি লাগায় সীমিত অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।’’ রাজীবকে দীর্ঘদিন ধরে চেনার সুবাদে তিনি জানালেন, রাজীবের শারীরিক গঠন বেশ রোগার দিকে। ওই উচ্চতায় শরীরের ওজন আরও কমে যায়, যা দুর্বলতা বা ক্লান্তির অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। রাজীবের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি ছিল বলে জানালেন তিনি।

হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘‘পর্বতারোহণ এমন একটা খেলা— যেখানে ছক্কা হাঁকানো নয়, ক্রিজে থাকাটাই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নিজের ক্ষমতা বিচার না করতে পারলে, মাসুল গুনতেই হবে।’’ ঠিক যে রকম ছন্দার ক্ষেত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়েই ফের ইয়ালুং কাং জয় করতে বেরোনোটা হঠকারিতা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন বারবারই উঠেছে।

রাজীবের দেহ উদ্ধারের কাজ কবে শুরু হবে? পশ্চিমবঙ্গ যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা

উজ্জ্বল রায় জানিয়েছেন, যে কোনও সাহায্যের বিনিময়ে হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে অভিযান আয়োজক সংস্থাকে। উদ্ধারকাজ তত্ত্বাবধানে শনিবারই কাঠমান্ডু যাওয়ার কথা পর্বতারোহী দেবদাস নন্দী ও দীপঙ্কর ঘোষের।

গত তিন বছর ধরে একের পর এক দুর্ঘটনায় জর্জরিত পর্বতারোহী মহল। অনিমেষবাবুর আক্ষেপ, ছন্দার ক্ষত এখনও দগদগে। তার আগে এই ধৌলাগিরি থেকেই অলৌকিক ভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন বসন্ত সিংহরায়। তার পরেও বারবারই দেখা যাচ্ছে, পর্বতারোহণ সংস্থাগুলি যতটা দ্রুততায় ও যতটা পেশাদার ভাবে বড় ব়ড় শৃঙ্গে অভিযান আয়োজন করে ফেলছে, ততটা পেশাদারিত্ব উদ্ধারকাজের ক্ষেত্রে দেখাচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajib bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE