ব্যাঙ্কশাল আদালতে আনা হচ্ছে সাজিদকে। ছবি: সুমন বল্লভ।
শুধু বর্ধমান মডিউলের মাথা নয়, ভারতে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর শেষ কথা ছিল সাজিদ ওরফে মাসুদ রাজা। বাংলাদেশ থেকে তাকে নির্দেশ দিত শাহিদা নামে এক মহিলা।
রাজ্য পুলিশ ও এনআইএ দু’জনেই এ কথা জেনেছে। বর্ধমান কাণ্ডের বাকি চাঁইদের পাশাপাশি শাহিদা-সহ আরও কয়েক জনের খোঁজেও এ বার নামছে এনআইএ।
এনআইএ সূত্রেরই খবর, ২০১২-এ পালিয়ে এসেছিল সাজিদ। তার পর এখানে জেএমবি-র মডিউলের মাথা হিসেবে দায়িত্ব পায় সে। বীরভূমের বাসিন্দা বুরহান শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুরহানের প্যান কার্ড ও ভোটার কার্ডে নিজের ছবি বসিয়ে নেয়। কার্ডগুলি উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। বিধাননগর কমিশনারেটের সন্ত্রাসদমন শাখার দাবি, শনিবার সাজিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার পর এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয় তাকে।
এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতে মুখ্য বিচারক মুমতাজ খানের এজলাসে সাজিদকে তোলা হয়। তার হয়ে কোনও আইনজীবী ছিল না। বিচারক তার বক্তব্য জানতে চাইলে ওই জঙ্গি বলে, “আমি বাংলাদেশে অপরাধী ছিলাম। এখানে বাঁচার জন্য এসেছি। আমি ভারতীয় হিসেবে এখানে থাকতে চাই।”
৫ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার সাজিদকে দেখে এ দিন অবশ্য অনেকেই অবাক হয়েছেন। সে যে এত বড় জঙ্গি, চেহারা দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁদের। তবে এনআইএ বলছে, সাজিদই ছিল এ দেশে জেএমবি-র শেষ কথা। আদালতে এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষও সেই দাবি করেন।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের দিন মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের একটি মাদ্রাসায় ছিল সাজিদ। বিস্ফোরণের পর সে ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যায়। কিছু দিন পর ফের সে রাজ্যে ফিরে আসে। নদিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদে ঘুরেফিরে ডেরা বাঁধছিল সে। জেরায় সাজিদ জানিয়েছে, ৩-৪ দিন অন্তর ডেরা বদলানো হতো। তদন্তকারীদের দাবি, সাজিদ নিজে কোনও ফোন ব্যবহার করত না। তার সঙ্গে জনা পাঁচেক ছেলে থাকত। তাদের ফোন থেকেই বিভিন্ন জায়গায় সাজিদ যোগাযোগ রাখত।
বীরভূমের কীর্ণাহারের ঠিকানা দেখিয়ে এ দেশের ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করেছিল বাংলাদেশের নাগরিক সাজিদ। ওই তিনটি কার্ডেই তার নাম লেখা রয়েছে বুরহান শেখ, পিতা আলম শেখ। ছবি অবশ্য রয়েছে সাজিদেরই। নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের কীর্ণাহার-১ পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটার হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে বুরহানের। এ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ওয়েবসাইটেও জ্বলজ্বল করছে, সাজিদের ঠিকানা কীর্ণাহারের পরোটা গ্রাম। এই গ্রামেই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যয়ের দিদির বাড়ি!
কী ভাবে ধরা পড়ল সাজিদ?
বিধাননগর পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ক্রমাগত ডেরা বদলাতে বদলাতে অর্থসঙ্কটে পড়েছিল সাজিদ। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা লেনদেন করে, এমন এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। সেই সূত্র ধরেই সাজিদকে টাকার টোপ দেওয়া হয়। শনিবার বিমানবন্দরের কাছে সেই টাকা নিতে এলে তাকে পাকড়াও করা হয়। “ধরা পড়ার সময় সাজিদের পকেটে মাত্র ৫৬ টাকা ছিল,”বলছেন এক গোয়েন্দাকর্তা। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ধরা পড়ার পর নিজেকে বুরহান শেখ বলেই পরিচয় দিয়েছিল সাজিদ। তবে সে যে শিমুলিয়ার বুরহান নয়, তা-ও বলেছিল। তখন তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা জানান গোয়েন্দারা। শুনেই সে নিজের নাম জানায়, সাজিদ। এক গোয়েন্দাকর্তার বক্তব্য, “বাংলাদেশের সন্ত্রাস-দমন বাহিনী র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন) সাজিদকে খুঁজছে। তাদের হাত থেকে বাঁচতেই ভয়ে নিজের নাম স্বীকার করেছে সে।”
যদিও সাজিদের গ্রেফতারি নিয়ে একটি ভিন্ন বয়ানও মিলেছে। গোয়েন্দাদের একাংশ বলছেন, বিধাননগর পুলিশ আন্তর্জাতিক গাড়ি পাচার চক্রের একটি দলকে খুঁজছিল। পুজোর সময় তেমন একটি দলকে পাকড়াও করা হয়। তাদের জেরা করে এবং ঝাড়খণ্ড পুলিশ সূত্রে খবর পেয়ে জামশেদপুর থেকে শিস মহম্মদ নামে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়। গত বুধবার রাতে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ এবং বিধাননগর পুলিশের একটি দল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে হানা দিয়ে জাল নোট পাচারকারী এক যুবককে আটক করে। সে যে গাড়ি পাচার-চক্রের জড়িত, তা-ও জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
সম্প্রতি এনআইএ পুলিশকে জানিয়েছিল, বর্ধমান কাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গাড়ি পাচার চক্রের যোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনও ধরপাকড় হলেই যেন তাদের খবর দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বুধবার রাতেই মুর্শিদাবাদের ওই যুবকের ছবি এনআইএ-কে পাঠানো হয়। সেই যুবকের ছবি ও বিবরণ দেখে সাজিদ বলে শনাক্ত করেন এনআইএ-র অফিসারেরা।
সাজিদকে আদালতে হাজির করানো নিয়ে এ দিন সকাল থেকেই চিন্তিত ছিলেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। জেএমবি-র কেন্দ্রীয় কমিটি মজলিস-এ-সুরার সদস্যকে আনার আগেই কলকাতা পুলিশের সহকারী কমিশনার বিকাশ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশবাহিনী নগর দায়রা আদালত ঘিরে ফেলে। বেলা আড়াইটে নাগাদ বিধাননগর পুলিশের ভ্যানে চাপিয়ে সাজিদকে আনা হয়। তার জন্য আলাদা লক-আপের ব্যবস্থা ছিল। বেলা তিনটের পরে এজলাসে নিয়ে যাওয়া হয় সাজিদকে। বিচারক তাকে ১১ দিনের জন্য এনআইএ হেফাজতে পাঠিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy