শশী পাঁজার সভায় হাজির গোপাল তিওয়ারি। রয়েছেন তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সী এবং তপন রায়ও। — ফাইল চিত্র
মাথা ছোঁয়ার সাহস নেই। তাই কান টানারও সাহস পাচ্ছে না লালবাজার!
সে আলিপুর থানার ওসিকে তৃণমূল নেতার হুমকি দেওয়ার ঘটনা হোক বা বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরে হামলা। এমনকী গিরিশ পার্কে এসআই গুলিবিদ্ধ হওয়ার মামলাতেও মাথা তো দূরস্থান, কান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি লালবাজার! সেই একই কারণে কাশীপুরের গোলমালে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে যাঁদের নাম উঠে এসেছে, সেই তৃণমূল নেতারাও ঘুরছেন বহাল তবিয়তে।
কলকাতা পুলিশের একটি অংশের বক্তব্য, ‘রুল বুক’ মেনে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করাই যায়। কিন্তু সেই ঠ্যালা সামলাবে কে! ওই পুলিশকর্মীদের বক্তব্য, যেখানে গোলমাল দেখে লাঠি চালানোর নির্দেশের জন্যও লালবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সেখানে কান-মাথা কোনওটাই টানাটানির প্রশ্ন নেই! লালবাজারের পদস্থ কর্তারা অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও কথাই বলতে চাননি। যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেছেন, ‘‘তদন্ত চলছে। তাই এখনই কোনও মন্তব্য করা যাবে না।’’ একই কারণ দেখিয়েছেন গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষও।
পুলিশ সূত্রে খবর, গিরিশ পার্কে এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার ঘটনায় মূল চক্রী হিসেবে নাম উঠেছে মধ্য কলকাতার দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারির। তাকে ধরতে লালবাজারের এক দল অফিসার উঠেপড়ে লাগলেও পিছনে শাসক দলের নেতাদের মদত থাকায় সে এখনও অধরাই! গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্রের আশঙ্কা, রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে গোপাল সম্ভবত রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছে। অথচ এসআই গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় নাম জড়ানোর পরেও দু’দিন সে কলকাতাতেই ছিল! পুলিশের অনুমান, সোমবার বিকেলে সে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার দেখে জানা গিয়েছে, সোমবার রাতেও গোপাল তারাপীঠে ছিল। তার পর থেকে আর তার সন্ধান পায়নি পুলিশ।
গিরিশ পার্ক কাণ্ডে ধৃত দুই দুষ্কৃতী তথা গোপাল তিওয়ারির শাগরেদ ইফতিকার আলম ও মনোজ মালির সঙ্গে মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ছবি সোমবারই সামনে এসেছে। মঙ্গলবার আরও একটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে গোপালের সঙ্গে একই মঞ্চে রয়েছেন সঞ্জয়বাবু ও রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। সঞ্জয়বাবু যেমন ইফতিকার ও মনোজকে চিনতে পারেননি, তেমনই শশীদেবীও বলেছেন, ‘‘মঞ্চে আমার পিছনে কে, কখন উঠছে কী ভাবে জানব?’’ সঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘আমরা মঞ্চের সামনে বসি। পিছনে কে কখন উঠে পড়ল, বুঝতে পারি না।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, ভোটের দিন গিরিশ পার্কে এসআই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গোপাল শাসক দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে একাধিক বার কথা বলেছে। গোয়েন্দারা সেই প্রমাণ জোগাড়ও করেছেন। পুলিশ জেনেছে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত সে পাথুরিয়াঘাটায় নিজের বাড়িতে ছিল। সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছে! তার পরেও পুলিশ তাকে ধরেনি! এক পুলিশ অফিসারের ব্যাখ্যা, ‘‘গোপাল গ্রেফতার হলে তার মদতদাতাদের পরিচয় আরও প্রকট হতো। তাতে শাসক দলের অস্বস্তি বাড়ত। তাঁরা রুষ্ট হতেন কর্তাদের উপরে, আর কর্তারা আমাদের উপরে!’’
শাসক দলের সেই রোষ থেকে বাঁচতেই ১৪ এপ্রিল রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরে হামলা এবং আলিপুর থানার ওসিকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত প্রতাপ সাহাকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। গত নভেম্বরে আলিপুরেই প্রতাপের লোকজনের হাতে মারধর খেয়েছিল পুলিশ! তা-ও থানার মধ্যেই! কিন্তু প্রতাপের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় পুলিশ ‘প্রমাণ জোগাড় করতে না পারায়’ চার্জশিটে তাঁর নাম বাদ যায়। লালবাজারের একাধিক সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই প্রতাপ সাহা। সে কারণেই মার খেয়েও পিছিয়ে এসেছে পুলিশ। ফিরহাদ অবশ্য বলেছেন, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে। সেখানে আমরা কোনও হস্তক্ষেপ করি না।’’
আলিপুরের ১৪ এপ্রিলের ঘটনার জেরে সে দিনই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর করলেও সাত দিন পরেও প্রতাপের টিকি ছুঁতে পারেনি পুলিশ। সেই সুযোগে আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করেছেন প্রতাপ। লালবাজারেরই একটি অংশের অভিযোগ, আগাম জামিনের সুযোগ করে দিতেই প্রতাপকে গ্রেফতার করা হয়নি। গোপাল অবশ্য প্রতাপের পথে হাঁটেনি। পুলিশের একাংশের দাবি, বিপদ বুঝে নেতাদের সাহায্য নিয়ে সে পালিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, গোপালকে ‘সেফ প্যাসেজ’ দিতেই কি তাকে ধরা হয়নি? কলকাতা পুলিশের একাধিক সূত্র তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছে।
লালবাজারের অন্দরের খবর, শনিবার রাতেই গোপালকে ধরার প্রস্তুতি নেন গোয়েন্দারা। সেই মতো একটি দল রওনা হয়। কিন্তু জানা যায়, গোপাল তখন এক বিধায়কের অফিসে বসে। অগত্যা ফিরে আসে দলটি। কয়েক জন দাবি তোলেন, ওই বিধায়কের অফিসের বাইরে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা হোক। কিন্তু তারও অনুমতি মেলেনি।
কয়েক জন পুলিশকর্তা বলছেন, সে দিন ঘটনাস্থলে গোপাল ছিল না। তাই সরাসরি তার নাম এই মামলায় জড়ানো যায় না। যদিও তদন্তকারীদের বড় অংশ এই যুক্তি উড়িয়ে বলছেন, ধৃতরা জেরায় স্বীকার করেছে যে গোপালের নির্দেশেই ভোটে কাজ করছিল তারা। গোলমালের পরিকল্পনাও গোপাল জানত। তাদের সেই বয়ান নথিভুক্ত করে গোপালকে অনায়াসে এই মামলায় জড়ানো যায়।
গোপাল-অন্তর্ধানের পিছনে পুলিশের একাংশের দিকেও আঙুল উঠেছে। পুলিশেরই একটি সূত্র বলছে, গোপালের সঙ্গে গুন্ডাদমন শাখার এক ইনস্পেক্টরের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। শনিবার রাতেই গোপালের হয়ে তদ্বির করতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে গোয়েন্দাকর্তারা তাঁর কথায় কান দেননি। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, গোপাল-ঘনিষ্ঠদের থেকে খবর পেয়েই ইফতিকার আলম-সহ দু’জনকে পাকড়াও করা হয়। ‘‘কয়েক জন ছুটকো দুষ্কৃতীকে ধরিয়ে নিজে বাঁচতে চাইছে গোপাল। তাকে মদত দিচ্ছে পুলিশের একাংশ!’’ বলছেন এক গোয়েন্দাকর্তা।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কাশীপুরের বাসিন্দারাও। বাংলা নববর্ষের রাতে সেখানে বোমাবাজি করে দু’দল দুষ্কৃতী। নাম জড়ায় স্থানীয় তৃণমূলের দু’টি ভিন্ন গোষ্ঠীর নেতা স্বপন চক্রবর্তী ও আনোয়ার খানের। কিন্তু তাঁদের কাউকেই গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
তৃণমূল সূত্রে খবর, স্বপন চক্রবর্তী বাম জমানায় সিপিএম ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পালাবদলের পর তৃণমূলে ভিড়েছেন। তিনি সিঁথি এলাকার কাউন্সিলর শান্তনু সেনের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। উল্টো দিকে স্বপন ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, আনোয়ারকে মদত দেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। তাই পুলিশ আনোয়ারকে ধরছে না। শান্তনুবাবুর দাবি, ‘‘কাউকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাব, এত বড় নেতা আমি নই।’’ আনোয়ারকে চিনলেও সাধনবাবুর বক্তব্য, ‘‘কেউ অপরাধ করলে পুলিশ তাকে ধরবে। আমি আটকাতে যাব কেন!’’
পুলিশ সূত্রের খবর, দলীয় সমীকরণে স্বপনের মদতদাতা গোষ্ঠীটি এখন কোণঠাসা। তাই তাঁকে ধরতে প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে নির্দেশও এসেছিল। তা হলে ধরা হল না কেন? পুলিশকর্তাদের ব্যাখ্যা, ওই ঘটনায় দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই সমান অভিযোগ আছে। স্বপনকে ধরলে আনোয়ারকেও ধরতে হতো। তাই গ্রেফতারির পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy