আমজনতাকে ‘সুরক্ষা’ জোগাতে তার আবির্ভাব। এখন দেখা যাচ্ছে, তার নিজেরই কোনও রক্ষাকবচ নেই! ধুঁকতে ধুঁকতে কোনওক্রমে নামটুকু শুধু টিকিয়ে রেখেছে। সুরক্ষার আশায় তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না কেউ!
সেই মুমূর্ষুর নাম: আর্থিক সুরক্ষা প্রকল্প (সেফ সেভিংস স্কিম)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প, যার জন্ম সারদা কেলেঙ্কারির পটভূমিতে। সারদা-কাণ্ড সামনে আসতেই রাজ্যবাসীর ক্ষোভ সামাল দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’টি ঘোষণা করেছিলেন। এক, কেলেঙ্কারির তদন্ত ও প্রতারিত আমানতকারীদের টাকা ফেরতের জন্য শ্যামল সেন কমিশন গঠন। দুই, রাজ্য সরকারের নিজস্ব একটি আর্থিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করা, যাতে এমন কেলেঙ্কারির পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
শ্যামল সেন কমিশনের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়েছে আগেই। এমনকী, রাজ্য সরকার তার রিপোর্টও গ্রহণ করেনি। আর ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঠিক দু’বছরের মাথায় সেফ সেভিংসেরও প্রায় তেমনই হাল। ঠিক দু’বছর আগে, ২০১৩-র ৬ নভেম্বর কলকাতার টাউন হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যার সূচনা করেছিলেন, কার্যক্ষেত্রে সেটি সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত। কী রকম?
অর্থ দফতরের খবর: সেফ সেভিংসে এ যাবৎ জমা পড়েছে কুল্লে সাড়ে তিন কোটি টাকার কিছু বেশি। এর আড়াই কোটি-ই এসেছিল
প্রথম পাঁচ মাসে। তার পরে জমার পরিমাণ ক্রমে কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বস্তুত অর্থ-কর্তাদের অনেকের মতে, এখন এটি চালিয়ে যাওয়া আর ডাইনোসর পোষা একই ব্যাপার।
প্রকল্পটি চালু করার সময়ে এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে বলেছিলেন, ‘‘বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে মানুষ ধনে-মানে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। দুর্বলতর ও সাধারণ মানুষ যাতে বঞ্চিত না হন, তাই প্রকল্পটি শুরু করছে রাজ্য সরকার।’’ তুলনায় কম বা সমান সুদের এই ‘স্কিমে’ টাকা রাখতে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবেন কেন, তারও ব্যাখ্যা দেন মমতা। ‘‘কত সুদ পাবেন, সেটা বড় কথা নয়। জনগণের টাকার নিরাপত্তাই এখানে অগ্রাধিকার পাবে।’’— বলেছিলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ কিন্তু তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করে রেখেছিলেন যে, উদ্যোগটিতে সাফল্য পাওয়া কঠিন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, এটি অবাস্তব প্রকল্প। কারণ, সাধারণ মানুষের টাকা নিরাপদে গচ্ছিত রাখার জন্য ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে একাধিক স্কিম রয়েছে, যেগুলো চালানো হয় যথেষ্ট পেশাদারি দক্ষতায়। তা ছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের তরফে গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধা দেওয়াও সম্ভব নয় বলে দাবি করেছিলেন ওঁরা।
আশঙ্কার পিছনে আরও যুক্তি দেখানো হয়। সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য ছিল: সাধারণ মানুষ অবৈধ লগ্নিসংস্থায় টাকা রাখে মূলত চড়া সুদের প্রলোভনে ভুলে। দেখা গিয়েছে, এই প্রবণতা যখনই বেড়েছে, তখনই ডাকঘর স্বল্প সঞ্চয়ে জমার বহর কমেছে। এমনকী, অনেকে পোস্ট অফিস, জীবনবিমা বা ব্যাঙ্কে রাখা টাকা তুলে এনেও বেআইনি সংস্থায় জমা দিয়েছেন। কাজেই সর্বাগ্রে দরকার ওই জাতীয় সংস্থার কাজকর্মে নজরদারি ও মানুষকে সচেতন করা। অবৈধ লগ্নি-কারবারের রমরমার জন্য ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার দিকেও আঙুল ওঠে। অর্থনীতিবিদেরা অনেকে অভিযোগ করেন, ব্যাঙ্কে টাকা রাখার সুযোগ না-পেয়েও বহু লোক অবৈধ সংস্থার খপ্পরে পড়েন। অনেকে আবার ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে কাগজপত্রে লেখালেখির ঝক্কি পোয়ানোর বদলে ভুঁইফোড় কোম্পানির এজেন্টের হাতে টাকা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।
এমতাবস্থায় প্রতারণা ঠেকাতে হলে কড়া নজরদারি-নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামো জোরদার করার পক্ষেসওয়াল ওঠে। অর্থনীতিবিদদের একাংশ এ-ও বলেন, ব্যাঙ্ক-ডাকঘরে টাকা রাখার ব্যাপারে সরকারের তরফে লাগাতার সচেতনতা-প্রচার জরুরি। তা না-করে
রাজ্য সরকারি প্রকল্প খাড়া করে সারদার মতো সংস্থার মোকাবিলার চেষ্টা কখনও সাফল্য পেতে পারে না বলে ওঁরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
আশঙ্কা দু’বছরের মধ্যে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে। উপরন্তু সেফ সেভিংসের ভরাডুবির জন্য টাকা জমা করার ‘জটিল’ পদ্ধতিকেও দুষছেন অর্থ-কর্তাদের কেউ কেউ।
কেন? দফতরের খবর: সেফ সেভিংসের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা হল পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন বিত্ত নিগম (ডব্লিউবিআইডিএফসি), যে কিনা আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক-পরিষেবার উপরে নির্ভরশীল। তাই আমানতকারীকে আগে ইউবিআইয়ের শাখায় গিয়ে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেফ সেভিংসের টাকা জমা দিতে হবে সেখানেই। পরে ব্যাঙ্ক আকাউন্ট থেকে টাকা স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু বিস্তর লোক তো স্রেফ ব্যাঙ্কে টাকা জমার ‘ঝকমারি’ এড়ানোর তাগিদেই বিকল্প খোঁজে। সে ক্ষেত্রে এই বন্দোবস্ত কতটা
কাজে দেবে?
খাস নিগমের অন্দরেও প্রশ্নটা প্রকট। ‘‘যদি ব্যাঙ্কে গিয়েই টাকা জমা দিতে হয়, তা হলে লোকে সরকারি স্কিমে আসবে কেন?’’— বলছেন নিগমের এক কর্তা। নিগম-সূত্রের খবর: সেফ সেভিংসের অংশীদার হতে সব ক’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করা হয়েছিল। পাওয়া গিয়েছে শুধু ইউবিআই-কে। এমনকী, এ রাজ্যের কোনও গ্রামীণ ব্যাঙ্কও এতে সামিল হয়নি। ফলে যেখানে ইউবিআইয়ের শাখা নেই, সেখানকার মানুষের কাছে প্রকল্পে লগ্নি করা বিস্তর সমস্যা। অর্থ-আধিকারিকেরাও মানছেন, একটা মাত্র ব্যাঙ্ককে দিয়ে এমন প্রকল্প চালানো যথেষ্ট কঠিন।
সর্বোপরি উঠছে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন। ব্যাঙ্ক-ডাকঘরে এ রকম অনেক সঞ্চয় প্রকল্প চালু রয়েছে। সুদের হার প্রায় একই, সেগুলোর নিরাপত্তাও সংশয়াতীত। ‘‘সে সব ছেড়ে এত হ্যাপা সামলে লোকে কেন রাজ্য সরকারের স্কিমে টাকা রাখবে, তা কারও বোধগম্য হয়নি।’’— আক্ষেপ করেছেন অর্থ দফতরের এক পদস্থ অফিসার। জানিয়েছেন, প্রকল্পে ৬৫৪ জন এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের হার উৎসাহব্যঞ্জক না-হওয়ায় এজেন্টরা মন দিয়ে কাজ করছেন না, নতুন এজেন্ট হতে ইচ্ছুক লোকও মিলছে না।
সব মিলিয়ে ঘোষণায় যতটা যত্ন নেওয়া হয়েছিল, প্রকল্পকে মজবুত করতে তার সিকি ভাগও দেখা যায়নি বলে হা-হুতাশ শোনা যাচ্ছে সরকারের অন্দরমহলে। অর্থ-আধিকারিকেরা বলছেন, কোনও সঞ্চয় প্রকল্প ঘোষণার আগে সাত-পাঁচ খতিয়ে দেখতে হয়। আমানত সংগ্রহ ও পরিকাঠামো তৈরির সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছকে তবেই পা ফেলতে হয়। অথচ এ ক্ষেত্রে সে সবের বালাই রাখা হয়নি। কর্তারা তা হলে গোড়াতেই আপত্তি তোলেননি কেন?
‘‘তোলা তো যেতই! কিন্তু কার বুকের অত পাটা?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন অর্থ দফতরের এক কর্তা। নিগম-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
নিগমের অফিসে ফোন করা হলে এক মহিলা বলেন, ‘‘ডিরেক্টর ম্যাডাম এখানে খুব কম আসেন। এখান থেকে ফাইল পাঠানো হয়।’’ তিনি আর একটি অফিসের নম্বর দেন। সেখানকার ফোন ধরে এক পুরুষকন্ঠ বলেন, ‘‘ডিরেক্টর স্মারখি মহাপাত্র কলকাতার বাইরে। এখন কোনও ভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা
যাবে না।’’
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মতামত নেওয়ারও চেষ্টা হয়েছিল। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy