(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল গান্ধী (ডান দিকে)। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
শুরুর দিনেই বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট আলোচনার ইতি হয়ে গিয়েছিল। তৃণমূল সূত্রে তেমনই খবর। শেষমুহূর্তে কোনও অভাবনীয় ‘মোচড়’ না ঘটলে লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে আলাদাই লড়বে কংগ্রেস এবং তৃণমূল। বাংলার শাসক দল লড়বে ৪২টি আসনেই। শুক্রবার পর্যন্ত তেমনই ‘মুড’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিবিরের।
তৃণমূল সূত্রের খবর, রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনায় বসে মমতা প্রথমেই তাঁকে দু’টি আসন ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই আসনগুলি হল বহরমপুর এবং মালদহ-দক্ষিণ। অর্থাৎ, অধীর চৌধুরী এবং আবু হাসেম খান চৌধুরির দু’টি আসন। আলোচনা ‘ইতিবাচক’ হলে মমতা রায়গঞ্জ আসনটিও কংগ্রেসকে দেওয়ার বিষয়ে ভেবে রেখেছিলেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি। কিন্তু মমতা দু’টি আসনের কথা বলতেই রাহুল বলে বসেন, ১০ বা ১২টি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে হবে তৃণমূলকে। নইলে আসন সমঝোতার কোনও অর্থ হয় না। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘দিদি তখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। তখনই ঠিক হয়ে যায়, কংগ্রেস এই রকম অযৌক্তিক দাবি করলে বাংলায় জোট হবে না।’’ রাহুলের দাবির সূত্র ধরেই তৃণমূলের ওই শীর্ষনেতা শুক্রবার বলেন, ‘‘দোষ দেওয়া হচ্ছে আমাদের। কিন্তু অবাস্তব এবং অযৌক্তিক দাবি করে জোটটা কারা ভেঙেছে?’’
প্রসঙ্গত, গত বুধবার মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, কংগ্রেস প্রথমেই তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। সেই প্রস্তাব কী ছিল, তা অবশ্য মমতা প্রকাশ্যে জানাননি। শুক্রবার তৃণমূলেরই একটি সূত্রে সেই প্রস্তাবের কথা এবং সে বিষয়ে রাহুলের বক্তব্য জানা গিয়েছে। যদিও কংগ্রেসের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে এর সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, মমতা ‘নমনীয়’ হচ্ছেন না। তাই জোট নিয়ে আলোচনা এগোচ্ছে না। মমতা অবশ্য বাংলা ছাড়া বাকি দেশে ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে আশাবাদী। তিনি এমনও বলেছিলেন যে, ‘‘আমরা অবিজেপি আঞ্চলিক দলেরা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাই। কী ভাবে সেটা করব, সেটা আমরা দরকারে ভোটের পরে বসে ঠিক করে নেব।’’ তৃণমূল নেত্রীর ওই বক্তব্যেই স্পষ্ট যে, তিনি কংগ্রেসের উপর ‘ক্ষুব্ধ’ হয়ে রয়েছেন। তৃণমূলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, যে ভাবে কংগ্রেস জোটের অন্দরে ‘দাদাগিরি’ করছে, তা ঘোর অপছন্দ তাঁদের নেত্রীর।
মমতার ঘনিষ্ঠমহলের দাবি, রাহুলকে নিয়েও তৃণমূল নেত্রীর ‘অনুযোগ’ রয়েছে। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘মমতাদিই ইন্ডিয়া নামটা দিয়েছিলেন। যদি রাহুল গান্ধী আমাদের নেত্রীকে মর্যাদা দিতে চাইতেন, তা হলে অন্তত বাংলা থেকে তাঁর ন্যায় যাত্রা শুরু করতে পারতেন! সেটা করা তো দূরস্থান, দিদিকে ওই বিষয়ে কিছু জানানোও হয়নি। এটাই কি জোটের শরিকদের সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব?’’ কংগ্রেস অবশ্য দাবি করেছে, মমতাকে রাহুলের বাংলা পর্বের ন্যায়যাত্রায় বিধিবদ্ধ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, মমতা বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলতেই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মমতা এবং তৃণমূলের ‘স্তুতি’ শুরু করেছেন। বলা হয়েছে, মমতা এবং তৃণমূল ‘ইন্ডিয়া’র আসল স্তম্ভ। এমনও দাবি করা হয়েছে যে, কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে মমতাকে ফোন করেছিলেন। যদিও শুক্রবার মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রে সে কথা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্টে বলা হয়েছে, পূর্ব বর্ধমানের সরকারি কর্মসূচি সেরে ফেরার পথে মমতা কপালে আঘাত পাওয়ার পরে তাঁর খোঁজ নিতে ফোন করেছিলেন সনিয়া গান্ধী। মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে মমতার খোঁজ নেন সনিয়া-কন্যা প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢড়াও। কিন্তু খড়্গে কোনও ফোন করেননি বলেই মমতার ঘনিষ্ঠদের দাবি। তাঁদের আরও বক্তব্য, মমতার যেদিন চোট লেগেছিল, তার পরদিনই রাহুল বাংলায় ঢুকেছেন তাঁর যাত্রা নিয়ে। কিন্তু তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর খোঁজ নেওয়ার বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি।
মমতা ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, নীতীশ কুমার সম্পর্কে আগেই ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের সতর্ক করেছিলেন মমতা। তিনি জানিয়েছিলেন, নীতীশ বিজেপির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তাই তাঁকে ‘আহ্বায়ক’ করার প্রয়াসে তিনি শামিল হননি। সেই কারণেই ‘ইন্ডিয়া’র শেষ ভার্চুয়াল বৈঠকেও মমতা ছিলেন না। সেদিন তাঁর সাগরমেলার প্রস্তুতি দেখতে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল। সূত্রের খবর, মমতাকে ‘ইন্ডিয়া’র আহ্বায়ক হিসেবে নীতীশের নামে রাজি করানোর জন্য অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং উদ্ধব ঠাকরেকে অনুরোধ করা হয়েছিল কংগ্রেসের তরফে। কিন্তু তাঁরাও খুব একটা গা করেননি। বরং দু’জনেই বলে দেন, মমতাকে ছাড়া ওই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। মমতা নিজেও জানিয়ে দেন, গঙ্গাসাগরে তাঁর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি রয়েছে। তিনি ওই ‘ভার্চুয়াল’ বৈঠকে যোগ দিতে পারবেন না। তৃণমূলের অন্য কোনও প্রতিনিধিও সেই বৈঠকে যোগ দেননি।
মমতার অনুপস্থিতিতেই সেই বৈঠকেই নীতীশের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তিনি আহ্বায়ক হতে রাজি হননি। শুক্রবার মমতা তাঁর ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, এতে শাপে বর হয়েছে। বিরোধী জোটের আহ্বায়ক যদি বিজেপির সঙ্গে চলে যেতেন, তা হলে তার রাজনৈতিক অভিঘাত আরও অনেক নেতিবাচক হত। অন্তত সেই বিষয়টি এড়ানো গিয়েছে।
মমতার ঘনিষ্ঠদের দাবি, বাংলায় ৪২টি আসনে একা লড়াই করার বিষয়ে তৃণমূল নেত্রী মনস্থির করেই ফেলেছেন। যদিও কংগ্রেস হাইকমান্ড এখনও বরফ গলানোরক চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তৃণমূল আর সমঝোতার জায়গায় নেই বলেই দলের শীর্ষনেতারা মনে করছেন। ফলে বড় কোনও ‘মোচড়’ না হলে বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হওয়া কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy