Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Manoj Tiwari

হাওড়ার পিচ কি তৃণমূলের ক্রিকেট-তারকাদের জন্য কঠিন, ‘আউট’ হয়েছেন দু’জন, মনোজ টিকবেন?

মনোজের সঙ্গে হাওড়ার পুর প্রশাসক সুজয়ের যে সংঘাত, তাতে অন্য আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তৃণমূলে— বাঙালি-অবাঙালি ভাবাবেগের দ্বন্দ্ব। যা লোকসভা ভোটের আগে খুব একটা শুভ সঙ্কেত নয় বলেই মত অনেকের।

Speculations about the political future of minister and cricketer Manoj Tiwari have started within TMC in Howrah

মনোজ তিওয়ারি। —ফাইল চিত্র।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:০১
Share: Save:

শিবপুর থেকে বালিখাল— শহর হাওড়ার রাজনীতির পিচে তৃণমূলের ক্রিকেট- তারকারা কি ‘ঘূর্ণি’ সামলাতে পারছেন না? বুধ এবং বৃহস্পতিবার হাওড়ার ক্রিসমাস কার্নিভ্যাল নিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহ দেখা গিয়েছে, মন্ত্রী তথা ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারির যে অভিব্যক্তি দেখেছে হাওড়া তথা গোটা রাজ্য, তার পর দলের অন্দরে তাঁর ‘রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

হাওড়ায় তৃণমূলের ক্রিকেট তারকাদের জনপ্রতিনিধি হওয়া নতুন নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে পাশাপাশি দুই কেন্দ্র বালি ও উত্তর হাওড়ায় তৃণমূল প্রার্থী করেছিল ক্রিকেট জগতের দু’জনকে। বালিতে বৈশালী ডালমিয়া এবং উত্তর হাওড়ায় লক্ষ্মীরতন শুক্ল। বৈশালী ক্রিকেট না খেললেও ক্রিকেটই তাঁর পরিচয়। কারণ, তিনি বাংলা তথা ভারতীয় ক্রিকেটের খ্যাতনামা প্রশাসক প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার কন্যা। নিন্দকেরা বলেন, পারিবারিক ক্রিকেটীয় ঐতিহ্য ছাড়া ভোটের ময়দানে বলার মতো বৈশালীর আর কোনও পরিচয় ছিল না।

লক্ষ্মীরতন বাংলার অধিনায়ক ছিলেন। এখন কোচ। তিনি হাওড়ার ভূমিপুত্রও বটে। কিন্তু দু’জনেই কালক্রমে হাওড়ার পিচে নিজেদের উইকেট দিয়ে গিয়েছেন। বৈশালী প্রথম বার জেতার পর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে ২০২১ সালের ভোটে হেরেছিলেন। আর ২০২১ সালের ভোটের আগে ৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন লক্ষ্মীরতন। তবে তিনি অন্য কোনও দলে যাননি। বস্তুত, লক্ষ্ণীরতন রাজনীতিতেই আর সক্রিয় নন। তিনি ফিরে গিয়েছেন আদত ক্রিকেটে। বাংলা দলের কোচের ভূমিকায়।

রাজনীতিতে থাকাকালীন লক্ষ্মীরতন বড় দায়িত্বই পেয়েছিলেন শাসকদলে। মন্ত্রীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন সদর হাওড়ার জেলা সভাপতি। সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রী অরূপ রায়কে। কিন্তু ক্রিকেটের ‘অলরাউন্ডার’ লক্ষ্মীরতন রাজনীতির উইকেটের ‘ঘূর্ণি’ সামলাতে পারেননি। মন্ত্রী, জেলা সভাপতির ব্যাট-প্যাড ছেড়ে রাখতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সূত্রেই এ বার হাওড়ার তৃণমূল নেতাদের মুখে মুখে ঘুরছে মনোজের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা।

হাওড়ার পুর প্রশাসক সুজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রকাশ্যে বচসায় জড়িয়ে পড়েছেন মন্ত্রী মনোজ। দু’জনের বিতণ্ডার জেরে বুধবার হাওড়ায় ক্রিসমাস কার্নিভ্যাল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন তা চালু করার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস (মন্ত্রিসভায় মনোজ যাঁর ‘ডেপুটি’) মধ্যস্থতা করতে হাওড়ায় ছোটেন। তাঁর সামনেই দেখা যায় সুজয়কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছেন মনোজ। পরে অবশ্য অরূপ বলেন, ‘‘পায়ে পা লেগে গিয়েছিল।’’ কিন্তু তত ক্ষণে মনোজের মঞ্চে উঠে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানের কলি গাওয়া হয়ে গিয়েছে। ফলে সবশেষে মাঝে অরূপ এবং দু’পাশে সুজয় এবং মনোজের ছবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সন্দিহান হাওড়া।

প্রসঙ্গত, হাওড়ায় তৃণমূলের কাছে বিজেপির চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শহর হাওড়ায় অবাঙালি ভোটকে এককাট্টা করতে চায় গেরুয়া শিবির। সালকিয়া নন্দীবাগান এলাকার এক বিজেপি নেতা ঘরোয়া আলোচনায় প্রায়ই বলে থাকেন, ‘‘হাওড়া সদর লোকসভার জমি আমাদের জন্য উর্বর। কারণ, সেখানে বিপুল অবাঙালি হিন্দু ভোট রয়েছে। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্ব বিষয়টা নিয়ে সে ভাবে মাথা ঘামান না।’’

প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলও চায় অবাঙালি ভোটে তাদেরই আধিপত্য থাকুক। যে কারণে হাওড়া সদরের তৃণমূলের সাংগঠনিক জেলা কমিটিতে গত দু’টি মেয়াদ ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক লগনদেও সিংহ। একটা সময়ে সিপিএম যে লগনদেওকে ভিত্তি করে সালকিয়া, এসি মার্কেট, ঘাসবাগান, উড়িয়াপাড়া, মুরগিহাটা, ট্যান্ডেল বাগান এলাকার অবাঙালি ভোট পকেটস্থ করত। রাজ্য তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘অবাঙালি ভোট পেতেই বৈশালী, লক্ষ্মীরতন, মনোজদের প্রার্থী হিসেবে বেছেছিল দল। লগনদেওকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে কথা মাথায় রেখেই। কিন্তু কাকতালীয় হলেও বাস্তব যে, হাওড়ার রাজনীতির সঙ্গে ক্রিকেট-তারকারা মানিয়ে নিতে পারছেন না।’’

তবে সুজয়ের অনুগামীরা যেমন মনোজের বিরুদ্ধে ‘বেপরোয়া’ হওয়ার অভিযোগ তুলছেন, তেমন উল্টো দিকও রয়েছে। মনোজ অনুগামীদের বক্তব্য, পুর প্রশাসক হাওড়া শহরকে নিজের ‘সম্পত্তি’ বলে মনে করছেন। পুরসভার কোনও কিছুতেই মনোজকে যুক্ত করা হয় না বলেও দাবি তাঁদের। মনোজ-গোষ্ঠীর বক্তব্য, মন্ত্রী তথা শিবপুরের বিধায়ককে বাদ রেখেই তাঁর এলাকায় পুরসভার যাবতীয় কাজ করতে চান সুজয়। তবে এর নেপথ্যে অন্য সমীকরণও রয়েছে। যা শহর হাওড়ার তৃণমূলের সমীকরণের মূল ভিত্তি। মনোজ অনুগামীদের বক্তব্য, সুজয় আর এক মন্ত্রী তথা মধ্য হাওড়ার বিধায়ক অরূপ রায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’। তাঁর পিছনে সেই বড় ‘খুঁটি’ই কাজ করছে। নচেৎ সুজয় এ ভাবে মনোজকে এড়িয়ে পুরসভার কাজ চালাতে পারতেন না। অরূপের লোকজনের অবশ্য দাবি, মনোজ জেলার রাজনীতিতে কোনও বিষয়ই নয়। ওঁকে নিয়ে কেন অরূপ রায় মাথা ঘামাতে যাবেন!

মনোজের সঙ্গে পুর প্রশাসক সুজয়ের যে সংঘাত তৈরি হয়েছে, তাতে অবশ্য অন্য এক আশঙ্কা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। তা হল, দলের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি ভাবাবেগের দ্বন্দ্ব। যা লোকসভার আগে খুব একটা শুভ সঙ্কেত নয় বলেই অভিমত অনেকের। ব্যক্তিগত স্তরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা সুজয়কে পছন্দ করেন বলেই তৃণমূলের অনেকের দাবি। সেই সুজয়ের প্রতি মনোজের ‘বেপরোয়া’ মনোভাব, আগ্রাসী শরীরী ভাষা দলের উপরতলায় খুব ভাল বার্তা দেয়নি বলেই অনেকের আশঙ্কা। ক্রিকেটীয় পরিভাষা ধার করে অনেকে বলছেন, মনোজ ‘দুসরা’ বুঝতে না পেরে স্টেপ আউট করতে গিয়েছেন। উইকেট না চলে যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE