নেপালের কাঠমাণ্ডুর কাছে মাশিনি গ্রামে ভূমিকম্প দুর্গতদের হাতে ত্রাণ তুলে দিচ্ছেন কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা।—নিজস্ব চিত্র।
কাঠমান্ডু থেকে মেরেকেটে আড়াই ঘন্টার রাস্তা। উঁচু-নিচু টিলার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেড়শো পরিবারের বাস। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদের নাম মাশিনি।
দেশের রাজধানী থেকে এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও সরকারি বা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর তরফে কোনও সাহায্য মেলেনি ভূমিকম্পে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হওয়ার দশ দিন পরেও। শনিবার হঠাৎই ভগ্নস্তূপ ঠেলে ধ্বংসলীলার পরে প্রথম এলাকায় ঢুকল একটি ছোট পিক-আপ ভ্যান। তা থেকে নেমে এলেন জনা পাঁচেক তরুণ-তরুণী। ভ্যানে ভরা বিস্কুট, কেক, ছাতু, বেবিফুড, হরলিক্স, ত্রিপল, সোলার লাইট, প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ। সবই তাঁদের জন্য! অযাচিত এই উপহার পেয়ে ক্লান্ত মুখগুলো আনন্দে ভরে ওঠে। তাঁরা জানতে পারলেন, ছেলেমেয়েগুলির ঠিকানা, ভারতের কলকাতা।
গোটা বিষয়টি যাঁদের জন্য সম্ভব হল, মাশিনিতে গিয়ে নিজেদের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়ে আসা ছটফটে সেই তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকেই জানা গেল তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরাই জানালেন, পাঁচ জন গিয়েছিলেন নেপালে। আরও দশ জন কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত গিয়ে ফিরে গিয়েছেন। তবে বাংলার বেশ কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীও এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন। তাই একবার নয়, তাঁরা আবার ফিরে আসতে চান আরও কিছু ত্রাণ সংগ্রহ করে। এ বারে তাঁরা যাবেন নতুন গ্রামে।
গত ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের পরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ নিয়ে নেপালে গিয়েছে বহু দল। সরকারি-বেসরকারি যে যেমন ভাবে পেরেছেন, ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। অভিযোগ, কিন্তু সমস্তটাই হয়েছে রাজধানী কাঠমান্ডুকেন্দ্রিক। কাঠমান্ডু বিমানবন্দর লাগোয়া একটি ছোট বাসস্ট্যান্ডই এখন কাঠমান্ডুর বেঁচে থাকা মানুষের অস্থায়ী ঠিকানা। গোটা সংসারই চলছে ওই মাঠে। এই চেহারা দেখে এবং সরকারি ভাবে বাধা দেওয়াতে কাঠমান্ডু ছাড়িয়ে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছচ্ছে না প্রত্যন্ত এলাকায়। এই খবর পৌঁছনোর পরেই ছাত্র-ছাত্রীরা ত্রাণ নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন ৎাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
না পৌঁছানো এলাকায় পৌঁছানোর তাগিদেই পথে নেমেছিলেন তাঁরা। পথ চলতি মানুষ, লোকাল ট্রেন, বাস, ছোট-বড় দোকান থেকে অর্থ সাহায্য তুলতে শুরু করেন তাঁরা। তাঁদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে পথে নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান সহ আরও অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। সকলের মিলিত প্রায় দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে শিলিগুড়ি এসে পৌঁছন কিংশুক চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক তুঙ্গ, দেবার্ঘ ভারতী, সন্তু প্রকৃতিবাদীরা। শুক্রবার শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন ১৫ জন ছাত্র-ছাত্রী।
শনিবার সকালে পৌঁছে সেখান থেকেই জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন। কিন্তু নেপালে ত্রাণ নিয়ে যেতে বাধার সম্মুখীন হতে পারে, এই আশঙ্কায় তাঁরা যোগাযোগ করেন শিলিগুড়ির পরিবেশপ্রেমী সংগঠন হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরাই শিলিগুড়ি থেকে কাঁকড়ভিটা, এবং সেখান থেকে বাসে কাঠমান্ডু যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁরা সঙ্গে নেন দার্জিলিংয়ের পরিচিত নরবু শেরপাকে। কাঠমান্ডু থেকে ফের থানকোট। সেখান থেকে ছোট পিক-আপ ভ্যান ভাড়া করে তাঁরা পৌঁছন মাশিনিতে। সেখানে গ্রাম মুখিয়া বীর তামঙ্গ বেশ হিন্দি বোঝেন। তাঁর মাধ্যমেই ত্রাণ বিলি করা হয়। যেখানে দেশের বা জেলার কেউ খোঁজ নেয়নি, সেখানে বাচ্চা কিছু ছেলেমেয়ে ‘ইন্ডিয়া’ থেকে এসেছে এটাই তাঁদের কাছে বিস্ময়ের। আর এখানেই তৃপ্তি এই ছাত্রছাত্রীদের। এই দলের অন্যতম সদস্য কিংশুকের মতে, ‘‘অনেকেই আমাদের অর্থ সাহায্য করেছেন এই বিশ্বাসে যে, তাঁদের প্রতিটি পয়সা যেন ঠিক জায়গায় পৌঁছয়। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিজেদের হাতে জিনিসগুলি পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy