Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নেশায় বুঁদ, ক্লাসের পরীক্ষা শিকেয়

পুলিশ এবং বিভিন্ন নেশা মুক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্যারাকপুর শিল্পা়ঞ্চলের যুব সমাজের একটি বড় অংশ বিভিন্ন মাদকের নেশায় আটকে পড়েছেন। যার একটি বড় অংশ আবার পড়ুয়া।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৪
Share: Save:

রাতের মধ্যে আরও একটা রাত আছে। সে রাত কোথাও আলো ঝলমলে, কোথাও নিকষ কালো।

সুহৃদ দে (নাম পরিবর্তিত) নামের যে ছেলেটি উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা লাগোয়া একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়রিং কলেজে পড়তে এসেছিলেন, তাঁর দু’চোখ জোড়া স্বপ্ন ছিল। কফি হাউস, রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি— ছোটবেলা থেকে শোনা সংস্কৃতির সব পীঠস্থান এ বার তাঁর নাগালে।

এ হেন সাদাসিধে ছেলেটির জীবনের মোড় ঘুরে যায় এক রাতে। সে রাতে হস্টেলের আঁধার ছাদে পার্টি হয়েছিল। সে দিনই তার সঙ্গে পরিচয় হয় সেই বিশেষ বস্তুটির। প্রথমটাই অস্বস্তি হলেও পরে মজে গিয়েছিলেন সেই ধূমায়িত নেশায়। ভোররাত পর্যন্ত পার্টি চলেছিল। বব ডিলানের ‘নকিং অ্যাট দ্য হেভেনস ডোর’ গেয়ে তারা ‘সেলিব্রেট’ করেছিল। দিনটা ছিল ১৩ অক্টোবর, ২০১৬— যে দিন ডিলানকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হল। আর যে নেশায় সে রাতে বুঁদ হয়েছিলেন ডিলান ভক্তরা, তা ছিল ডিলানের প্রিয় মারিজুয়ানা, অর্থাৎ গাঁজা। সেই শুরু।

তারপর থেকে ক্রমশ সেই নেশায় আটকে পড়েন সুহৃদ। পরে গাঁজা থেকে ব্রাউন সুগার। যার ফল একটা-দু’টো নয়, তিন তিনটে সেমেস্টার ‘মিস’ করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায় তাঁর বাড়ির লোকেদের। কাঁদতে কাঁদতে সুহৃদ বাবার কাছে স্বীকার করেন, চাইলেও তিনি নেশা থেকে বেরোতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত টানা সাত মাস একটা নেশা মুক্তি কেন্দ্রে কাটান তিনি। সেখান থেকেই দেন একটি সেমেস্টারের পরীক্ষা। এখন আর হস্টেলে থাকেন না তিনি। নেশা মুক্তি কেন্দ্রের পাশেই একটি বাড়ির পেয়িং গেস্ট সুহৃদ এখন ওই নেশা মুক্তি কেন্দ্রের একজন ভলান্টিয়ার।

সুহৃদের ঘটনা কেবল একটা উদাহরণ মাত্র। পুলিশ এবং বিভিন্ন নেশা মুক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্যারাকপুর শিল্পা়ঞ্চলের যুব সমাজের একটি বড় অংশ বিভিন্ন মাদকের নেশায় আটকে পড়েছেন। যার একটি বড় অংশ আবার পড়ুয়া। কিন্তু তাজ্জব কথা, আগে এই শিল্পাঞ্চলের কয়েকটি বাছায় করা জায়গায় গিয়ে চরস, গাঁজা, হেরোইন নিয়ে আসতে হত। এখন আর সে হ্যাপা নেই। একটা ফোন কলেই হোম ডেলিভারি।

সুহৃদদের ব্রাউন সুগার সংগ্রহ কাহিনী আরও রোমহর্ষক। জানা গেল তাঁর কাছ থেকেই। ফোন করার আধ ঘণ্টার মধ্যে হস্টেলের পিছনের দিকে পাঁচিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হত। একটা সময় ও পার থেকে শিস-এর শব্দ এলে এ পার থেকে কাগজে টাকা মুড়ে ছুড়ে দেওয়া হত। মুহূর্তকাল পরে এ পারে উড়ে আসত একটা প্যাকেট। প্যাকেটেই থাকত রাতের মধ্যে আর একটা রাতের ঠিকানা। এই ঘটনা ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবির প্রথম দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে‌ দেয়। পঞ্জাব না হোক, এও আর একটা উড়তা এলাকারই গল্প। এমনটাই মনে করেন সুহৃদ। তিনি বলেন, ‘‘হয়তো এখনও এমনটাই হয়। আমি জানি না।’’

ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক পুলিশ কর্তা জানান, হালিশহর, কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, টিটাগড়-সহ বিভিন্ন রেল স্টেশনের পাশে এই হরেক কিসিমের নেশার নানান ঠেক। সন্ধ্যা বাড়লেই সেই ঠেকে বাইক-সাইকেলের ভিড় বাড়ে। হাতেহাতে হাত বদলায় প্যাকেট-পুরিয়া। যারা ঠেকে আসে না, তাদের জন্যও রয়েছে সরেশ বন্দোবস্ত। এক ফোনেই তা হাজির হয়ে যায় ঘরের দরজায় কিংবা নিজেদের ঠেকে। শুধু বাড়িতেই নয়, ব্যারাকপুর-কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারের বেশ কিছু পানশালাতেও পুরিয়া হাতবদল হয়। এখানে রাত সুহৃদদের মতো কালো নয়, ঝকমকে আলোর সে এক আশ্চর্য দুনিয়া।

এক পুলিশ অফিসার জানান, ফোন করলেই তো এখন ভাত-ডাল যেমন বাড়িতে পৌঁছে যায়, তেমনই এ জিনিসও। এখন তো সামজের একটা অংশের কাছে গাঁজা, চরস, হেরোইন-সহ বিভিন্ন ড্রাগস এখন ভাত-ডালের মতোই ‘নেসেসিটি’তে পরিণত হয়েছে। তা হলে পুলিশ করছেটা কী? এক পুলিশ কর্তার কথায়, সাধারণ অপরাধ ঠেকাতে অনেক পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু এ রকম সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমন্বয়টা জরুরি। তবে, দিন চারেক আগে জগদ্দলে পুলিশ দু’জন হিরোইন ‘ডেলিভারি বয়’-কে গ্রেফতার করেছে। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিংহ বলেন, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা ছাড়া এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drug Addiction Students Examination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE