ছবি তুলেছেন সুদীপ ঘোষ।
একটা শক্ত কঞ্চি এক দুর্বল মানুষ ভেঙে ফেলতে পারেন, কিন্তু একগাছা সরু কঞ্চিকে শক্তিমান মানুষও ভাঙতে পারেন না।
গল্পটা শুনিয়েছিলেন গ্রামেরই এক বৃদ্ধ কৃষক। তখন ঋণ নিয়ে সারা বছর পায়ের ঘাম মাটিতে ফেলে ধান, সব্জি চাষ করেও মুনাফা ঘরে তুলতে পারছিলেন না উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার বাবপুরের কৃষকরা। এরপরেই সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন ১২০ জন কৃষক। তৈরি হয় বাবপুর কৃষক সঙ্ঘ। সেই শুরু। বৈজ্ঞানিক উপায়ে একসঙ্গে চাষের সুফল তাঁরা পেয়েছেন মাত্র কয়েক বছরেই। এই সময়ের মধ্যেই কারও হয়েছে পাকা বাড়ি, কেউ কিনেছেন চার চাকা গাড়ি। কেউ ছেলেমেয়েকে গাড়ি করে পাঠাচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে।
কী ভাবে সম্ভব এই পরিবর্তন?
বাবপুরের চাষিরা তৈরি করেছেন কৃষক ক্লাব। বাড়ির উঠানো দাঁড়িয়ে রয়েছে নিজস্ব কয়েকটি চার চাকা আর ক্লাবের ম্যাটাডর গাড়ি। বারাসত থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে বাবপুরের প্রাসাদোপম বাড়িতে বসে সেই ‘একগাছা কঞ্চির’ গল্প শোনাচ্ছিলেন ‘কৃষক সঙ্ঘে’র সম্পাদক শঙ্কর জানা। তাঁর কথায়, ‘‘কোন সব্জির পরে কোন ফসল চাষ করলে লাভ হয়, কোন মরসুমে কোন ফসল চাষ করতে হয়, কী ভাবে জৈব সার ব্যবহার করে কীটনাশক কম দিতে হয়, কী ভাবে সারা বছর টমাটো, বাঁধাকপি বা ফুলকপির মতো সব্জি ফলানো যায়— এ সব কিছুই আমরা আগে জানতাম না। নিজের মর্জিতে ২-৫ বিঘা জমি চাষ করতাম। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার সেটাই হত।’’
কৃষক চারুচন্দ্র বাগ জানান, এরপরেই তাঁরা ঠিক করেন, সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে চাষ করবেন। কেন চাষে লোকসান হচ্ছে তা জানতে হবে। কী ভাবে ঠিকঠাক চাষ করা যায় জানতে হবে তাও। গ্রামে ডাকা হল, কৃষি আধিকারিক ও বিজ্ঞানীদের। প্রথমে গাছতলায় বসেই চলত কৃষি কর্মশালা। গ্রামেরই প্রবীণ চাষি (পরবর্তীতে কৃষক সঙ্ঘের সভাপতি) অধীর জানা-র দেওয়া তিন বিঘে জমিতে তৈরি হল বাবপুর কৃষক সঙ্ঘ। রামকৃষ্ণ মিশনের সহায়তায় তৈরি হল ঘর। এক দিকে চলতে থাকল ২ টাকার বিনিময়ে দাতব্য চিকিৎসালয়। অন্য দিকে কৃষকদের সভা, শিবির, কর্মশালা।
• বাবপুরের চাষিরা শুরু করেছেন অপ্রচলিত সব্জি চাষ। ব্রকোলি,
রেড ক্যাবেজ, চাইনিজ ক্যাবেজ, চেরি টম্যাটো, ব্রাসেল স্প্রাউটে ভরা খেত।
• মাঠের মধ্যে তৈরি হয়েছে পলি হাউস। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বছরভর
চাষ হচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, বিনস-এর মতো মরসুমি সব্জি।
• কৃষক সঙ্ঘের ৫৫ জন কৃষক ৭০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন।
উন্নত প্রজাতির রুই, চিতল, দেশি মাগুর, কই মাছের চাষ হচ্ছে।
শুরু হল ‘প্রচলিত’ পদ্ধতি ভেঙে বিজ্ঞান সম্মত চাষ। সারা বছরের জন্য ফুলকপি, বর্ষাকালে তথাকথিত ‘অসম্ভব’ পেঁয়াজ এবং অপ্রচলিত নতুন সব্জির চাষ। বাবপুরের জমিতে এখন গেলেই দেখা মিলবে, মাঠ ভর্তি ব্রকোলি, রেড ক্যাবেজ, চাইনিস ক্যাবেজ, ক্যাপসিকাম, চেরি টমাটো, পাকচুই, ব্রাসেল স্প্রাউটের মতো অপ্রচলিত সব্জির।
সুন্দর সব্জি-আঁকা কন্টেনারের মতো গাড়ি দেখিয়ে চাষিরা জানান, ক্লাবের এই ম্যাটাডরেই নিয়মিত সব্জি পৌঁছে যায় কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। কখনও কলকাতায় গিয়ে খুচরো বিক্রিও চলে। কৃষকেরা জানান, তাঁদের গাড়ি গেলেই ক্রেতাদের লাইন পড়ে যায় সল্ট লেকের মতো জায়গাতেও। কৃষক সঙ্ঘের সদস্য মনতোষ পাত্রের কথায়, ‘‘এখন ঋণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এসে আমাদের অনুরোধ করে।’’
মিলেছে সরকারি স্বীকৃতিও।
বাবপুরের কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ চাষের সুফল তুলে ধরতে ইতিমধ্যেই কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে কৃষক সঙ্ঘকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। মিলেছে বিভিন্ন বেসরকারি স্বীকৃতিও। উত্তর ২৪ পরগনার এক কৃষি আধিকারিক জানান, এ ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে অপ্রচলিত সব্জি চাষের জন্য কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে শঙ্কর জানার মতো কৃষক সঙ্ঘের চাষিদের জেলার সেরা চাষির শিরোপাও দেওয়া হয়েছে। সব্জির পরে বাবপুরে শুরু হয়েছে উন্নত প্রজাতির রুই (জয়ন্তী), চিতল, দেশি মাগুর, দেশি তেলাপিয়া, কই মাছের চাষও। এ ভাবেই এগিয়ে চলেছে কৃষক সঙ্ঘ।
জলদি জবাব
আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন কৃষি বিশেষজ্ঞেরা। আজ রাজ্যের প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথকুমার দে (বাঁদিক) এবং বর্ধমানের সহ-কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ।
• প্রচণ্ড গরমে বাগানের লিচু ফেটে যাচ্ছে। কালো হয়ে যাচ্ছে আম। এই অবস্থায় কী ভাবে লিচু ও আম রক্ষা করব?
দুর্গা তিওয়ারি, কৃষ্ণগঞ্জ
দীর্ঘদিন ধরে খরার পরে জমিতে জল দিলে গাছের ফল কিংবা সব্জি ফেটে যায়। ফল যাতে না ফাটে তার জন্য মাঝে মাঝে গাছে জল স্প্রে করতে হবে। অনুখাদ্য হিসাবে বোরন প্রতি লিটার জলে দু’গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
• পাটের পাতা পোকায় ফুটো করে দিচ্ছে। পোকার আক্রমণ রুখব কী করে?
বিপদভঞ্জন বিশ্বাস, তেহট্ট, নদিয়া
চলতি আবহাওয়া এই ধরনের পোকার উপদ্রবের জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রেও কারটাপ হাইড্রোক্লোরাইড অথবা ডাই মিথোয়েট প্রতি লিটার জলে দু’গ্রাম আঠার সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
• বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের জন্য বীজ ফেলার উপযুক্ত সময় কখন? বীজের জন্য কোথায় যোগাযোগ করব?
চন্দন মণ্ডল, পারুলিয়া, বর্ধমান
বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের জন্য উপযুক্ত সময় জুন মাসের মাঝামাঝি। চেষ্টা করতে হবে সেই সময় যত দ্রুত সম্ভব জমিতে বীজ ফেলতে হবে। না হলে বাজার ধরতে দেরি হয়ে যাবে। বীজের জন্য জেলা উদ্যান পালন দফতরেযোগাযোগ করতে হবে।
চিঠি পাঠানোর ঠিকানা
আনন্দবাজার পত্রিকা, জেলা বিভাগ, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১। মেল করুন: district@abp.in
সুযোগ-সুবিধা
• হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে নদিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর। জেলার ১৭টি ব্লকেই এই প্রশিক্ষণ চলবে বলে জানিয়েছেন দফতরের উপ-অধিকর্তা মিন্টু চৌধুরী। উৎসাহী বেকার যুবক-যুবতীরা ব্লক স্তরে এই প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি ব্লকের ৪০ জন করে তরুণ-তরুণী এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন।
• আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে চাষের কাজ করার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হল উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ২ জুন আলিপুরদুয়ার গ্রামের উত্তর চকোয়াখেতি গ্রামে এ ব্যাপারে একটি শিবির আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্যবিজ্ঞান ও মৌসম সেবা কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কৃষকদের নথিভুক্ত মোবাইল নম্বরে প্রতি সপ্তাহেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস এসএমএস করা হয়।
• জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ধমানের প্রায় ৫০টি সরকারি পুকুরে চারাপোনা ছাড়া হবে। জেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ অলোক মাজি জানান, পুকুরগুলির তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
• মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন ব্লকে চাষিদের মধ্যে বর্ষাকালীন পেঁয়াজের বীজ বিলি করা হবে। দিন কয়েকের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জেলার উদ্যান পালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, চাষ শেষে কৃষকদের বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হবে।
• সম্প্রতি কালনা ২ ব্লকের অকালপৌষ গ্রামে ৫০ জন কৃষককে নতুন কৃষিপদ্ধতি, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ, শস্য বৈচিত্রকরণ ও মাটি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy